- কল্লোল মজুমদার
২০১৬ সাল থেকেই জোট নিয়ে লুকোচুরি খেলছে বাম ও কংগ্রেস। কখনও আসন সমঝোতা, কখনও জোট, কখনও ঘনিষ্ঠতা, কখনও বা বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াই। লুকোচুরির এখনকার পর্বে ফের জোট গঠনের চেষ্টা চলছে দুই শিবিরের। কিন্তু ভোটের দু’মাস আগেও কোনও রফা কিছু হয়নি। আসন বণ্টন তো দূর অস্ত। অথচ ‘ইন্ডিয়া’ তৈরি হওয়ার পর অনেকদিন কেটে গেল।
ইতিমধ্যে মালদার মতো জেলায় যেখানে কংগ্রেস শক্তিশালী, সেখানে কংগ্রেসের সমস্ত আসন দাবি নীচুতলার সিপিএম কর্মীদের ক্ষুব্ধ করছে। একটা রাজনৈতিক জোট তৈরি রাতারাতি কোনও ব্যাপার নয় যে, চাইলাম আর হয়ে গেল। এর জন্য একদম নীচুতলার কর্মী-সমর্থকদের, যাঁরা আসলে জমিতে থেকে জোটকে কার্যকর করবেন, তাঁদের সহমত তৈরি হওয়া দরকার। সেটা কখনও হচ্ছে না, শেষমুহূর্তে জাস্ট উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে নীচুতলায় জোটকে কার্যকর করার সময় পাওয়া যাচ্ছে না।
কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের আসন সমঝোতার বিষয়টি আরও হাস্যকর। তৃণমূল নেত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি একা লড়াই করতে প্রস্তুত। এরপরেও কংগ্রেস নেতাদের একের পর এক পদক্ষেপ যেন ‘গায়ে পড়া’ বা ‘হ্যাংলামো’। এই দুই বিশেষণ আমার নয়, মালদার এক প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতার। হাসতে হাসতে তিনি একদিন বললেন, ‘মালদায় পাথর ছুড়ে রাহুল গান্ধির গাড়ির কাচ ভাঙা হল। আর এআইসিসি’র তরফে এক্স হ্যান্ডেলে ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে বিষয়টি ভুল খবর আখ্যা দিয়ে বলা হয়, এক মহিলা হঠাৎ রাহুলের গাড়ির সামনে চলে আসায়, আচমকা ব্রেক কষা হয়। সেই সময় সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত দড়িতে গাড়ির কাচ ভেঙে যায়।’
ওই নেতার জিজ্ঞাস্য, কেউ বিশ্বাস করবে? রাহুল গান্ধির গাড়ির কাচ তো বুলেটপ্রুফ। কংগ্রেসকে যখন আসন ছাড়তে রাজি নয় তৃণমূল, তখন কেনই বা আগ বাড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীকে রাজ্যের বকেয়া নিয়ে চিঠি লিখলেন রাহুল? সব মিলিয়ে কংগ্রেস কর্মীরাও বিষয়টিকে দলের হ্যাংলামোই বলছেন।
একই অবস্থা সিপিএমের। যেনতেনপ্রকারেণ কংগ্রেসের সঙ্গে জোটে পা বাড়িয়ে আছে। সীতারাম ইয়েচুরি থেকে মহম্মদ সেলিমের ভাবটা সেরকমই। অথচ ১৯৬৪ সালে কংগ্রেসকে সমর্থন করার রাজনৈতিক লাইনের জন্য টুকরো হয়েছিল অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি। তৈরি হয় সিপিএম। পরে ১৯৮১ সালে দীর্ঘ ১৭ বছর সম্পাদক থাকার পর কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার জন্য সিপিআই থেকে বহিষ্কৃত হতে হয়েছিল এসএ ডাঙ্গেকে। পরবর্তীতে একই কারণে একই হাল হয়েছিল সইফুদ্দিন চৌধুরীর। ২০০০ সালে দলের সঙ্গে তাঁর সম্মানজনক বিচ্ছেদ হয়েছিল।
এখন ওই একই দলের নেতারা আগ বাড়িয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করতে আগ্রহী। তবে কি ফের জ্যোতি বসুর সেই ‘ঐতিহাসিক ভুল’ ঘোষণা সিপিএমের কাছে সময়ের অপেক্ষামাত্র? সিপিএমের প্রকাশ্য অবস্থান এখন, বিজেপি ও কংগ্রেসের অর্থনৈতিক মডেলে কোনও পার্থক্য নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে বিজেপিকে রুখতে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট ছাড়া উপায় নেই। বামেদের শক্তি অনেক কমেছে।
কিন্তু হাতেগোনা দু’চারজন ছাড়া আড়ালে অধিকাংশ সিপিএম নেতার মত হল, কংগ্রেস নিয়ে একটা প্রকাশ্য সিদ্ধান্তে আসা দরকার। হয় জোট করব, না হলে করব না- অবস্থান স্পষ্ট করুন কেন্দ্রীয় নেতারা। সিদ্ধান্ত দ্রুত হোক। দলের অন্দরে প্রশ্ন উঠেছে, জোট কি শুধু নির্বাচনভিত্তিক। নির্বাচনের মাত্র কয়েকদিন আগে জোট গড়া কতটা যুক্তিযুক্ত? অতীতে জোট বলা হয়নি, নাম দেওয়া হয়েছে, সমঝোতা কিংবা অন্যকিছু। এই অস্পষ্টতা বিভ্রান্তি তৈরি করে।
তাছাড়া কংগ্রেসের সঙ্গে এখনও নীচুতলায় সিপিএমের কিছু নেতা-কর্মীর দূরত্ব আছে, বিশেষ করে যাঁরা দীর্ঘদিনের সমর্থক। তাঁদের অন্যতম অভিযোগ, সিপিএমের ভোটাররা যেভাবে কংগ্রেসকে ভোট দেয়, কংগ্রেসের ভোটাররা তা করেন না। বরং তৃণমূলের প্রতি তাঁদের টান বেশি। আবার রাজ্যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে যখন লড়াইয়ের বার্তা দেওয়া হচ্ছে, তখন কেন্দ্রীয় স্তরে সিপিএম নেতৃত্বের তৃণমূলের সঙ্গে এক মঞ্চে থাকা বিভ্রান্তি তৈরি করছে।
এই পরিস্থিতিতে বিজেপি ও তৃণমূল, দুই দলের বিরুদ্ধেই লড়াই করবে সিপিএম- মহম্মদ সেলিমের এই বার্তা যতই স্পষ্ট মনে হোক, সাধারণ জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারছে না। সব মিলিয়েই জোট ঘেঁটে একেবারে ঘোঁট। এর অন্যতম কারণ এ রাজ্যে জোটনীতি আসলে কী, তা এখনও অন্ধকারে।