- অমর মিত্র
ছোটবেলায় শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়কে একবার দেখেছিলাম রাস্তা থেকে। জানলা দিয়ে তাঁর ঘর দেখা যাচ্ছিল। বসে তাকিয়েছিলেন রাস্তার দিকেই। পথচলতি মানুষজন দেখছিলেন। বাইরে কত আলো, সেই অনুভবের ভিতরে ছিলেন হয়তো। তখন তাঁর অনেক বয়স হয়েছে। বার্ধক্য তাঁকে ঘরবন্দি করেছে। ইন্দ্র বিশ্বাস রোডের সেই বাড়ির পরে রাস্তা, রাস্তার পর একফালি কর্পোরেশনের পার্ক, তার ওপারে বন্ধু তারাশঙ্করের বাড়ি। কোন বছরের কথা মনে করতে পারা অসম্ভব। কিন্তু দূর থেকে ওই দেখা ছিল আমার কাছে অনেক। তখন বেলগাছিয়া পাইকপাড়া অঞ্চলে তারাশঙ্কর, শৈলজানন্দ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্যরা থাকতেন। থাকতেন গৃহবন্দি অসুস্থ কাজী নজরুল ইসলাম। লেখকদের চর্মচক্ষে দেখতে পাচ্ছি, এই বিস্ময়, বালক বয়স থেকে এখনও যেন যায়নি। লেখক থাকেন পাঠকের মানসলোকে, তিনি কীভাবে আমাদের পাশের বাড়ির বাসিন্দা হবেন!
তখন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়কে পড়েছি। তাঁর সেই আশ্চর্য গল্প পেয়ে গেছি অমৃত পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যায়। বলা যায়, সেই পাঠই যেন আমার কৈশোর থেকে মনের যৌবনে পদার্পণ। এখনও মনে পড়ে পরপর সাজানো ছিল শৈলজার বদলি মঞ্জুর, প্রেমেন্দ্র মিত্রের তেলেনাপোতা আবিষ্কার, গজেন্দ্রকুমার মিত্রর অব্যক্ত… এই রকম সব হীরকরত্নের মতো গল্প। বদলি মঞ্জুর পড়ে সেই সদ্য বড় হয়ে যাওয়া কিশোর যেভাবে মুগ্ধ হয়েছিল, যে অনুভবের ভিতরে জড়িয়ে গিয়েছিল, আজ এতবছর বাদে তা থেকে এক বিন্দুও সরে আসতে পারেনি। এখনও যেন এই গল্পের পাঠ তার কাছে প্রথম পাঠের মতো অনুভূতি-সঞ্চারী। এরপর শৈলজানন্দের কয়লাকুঠির গল্প পড়েছে সে। পড়েছে আরও সব বিচিত্র গল্প, ধ্বংসপথের যাত্রী এরা, অতি ঘরন্তী না পায় ঘর, কৃষ্ণা, জয়া, মারণ অস্ত্র- এই রকম কত যে গল্প!
কয়লাকুঠির আদিবাসী কুলিকামিন, তাদের অদ্ভুত জীবন, কয়লা খাদানের ভয়ানক অন্ধকারের কাহিনী নিয়ে শৈলজানন্দ তাঁর যৌবনকালে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন বাঙালির পাঠ-অভ্যাসকে। নিম্নবর্গের মানুষের জীবন, তাদের বেঁচে থাকার নিরন্তর প্রয়াস, তীব্র প্রেম, ভালোবাসা, জীবনের প্রতি অদ্ভুত তৃষ্ণা এই লেখককে চিনিয়ে দিয়েছিল আলাদা করে। বাংলা সাহিত্য সাধারণত চেনা সমাজ, চেনা মানুষের বাইরে কখনোই যেতে চায়নি। চেনা সমাজ বলতে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষজন তা সে গ্রাম হোক, শহরের হোক। এর ভিতরে ব্যতিক্রমও ঘটে গেছে বারবার। আর ব্যতিক্রমী মহেশ, অভাগীর স্বর্গ হোক বা তারাশঙ্করের গল্প, উপন্যাস হোক। শৈলজানন্দ বীরভূম, তারাশঙ্করও বীরভূম। শৈলজানন্দ লিখলেন কুলিকামিন কয়লা খাদানের কথা, আর তারাশঙ্কর লিখলেন মাটি আর মানুষের কথা। তারাশঙ্কর সমস্ত জীবন থেকে রানিগঞ্জ, আসানসোল হয়ে কলকাতায় পৌঁছে গল্প লিখতে লিখতে উপন্যাস লিখতে লিখতে সিনেমায় চলে গেলেন। এই নতুন মাধ্যমে অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়ে সাহিত্যে তেমন গভীর মনোযোগী হলেন না। আমাদের তো দুঃখ এইটাই। ছবি বানাতে বানাতে ছবির উপযোগী গল্পও লিখতে আরম্ভ করলেন। বড় লেখকের হাতে সেইসব গল্প অনায়াসে সিনেমায় আদৃত হল। সিনেমাতেও শহর থেকে দূরের কথা বললেন, কিন্তু তা তো সিনেমারই রীতিতে। তার ফলে ছাপার অক্ষরের পাঠক বঞ্চিত হলেন।
এমন হয়। শিল্পী, বাউন্ডুলে, উদাসী বাউল শৈলজা যেন থিতু হতে পারতেন না। তাঁর জীবনে তৃষ্ণাও ছিল অতি তীব্র। তাই দূর থেকে শহরে এসে শহরটাকে চিনেও নিয়েছেন আকণ্ঠ তৃষ্ণা নিয়ে। শহরকে অনুভব করেছেন হৃদয় দিয়ে, মনন দিয়ে। সেই অনুভব ছেয়ে গেছে তাঁর গল্পে। আবার তা ছেড়ে চলে গেছেন সিনেমায়। সেই মধ্যমণিকে চিনে নিতে চেয়েছেন গভীর ভাবে। অর্থ, প্রতিপত্তি পেয়েছেন। শেষে সিনেমাতেও যেন বিতৃষ্ণা এল। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় ছিলেন এক বিরল প্রকৃতির মানুষ। বিরল প্রকৃতির লেখকও নিশ্চয়। তাঁকে বিচার করা কঠিন। আর আমি সেই বিচারেও বসিনি। প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে জন্মানো এই সামান্য লেখক তাঁর গল্পকে কীভাবে হৃদয়ে গ্রহণ করেছে, সেই কথাই বলতে চেষ্টা করব।
শৈলজানন্দকে পড়লে, ঘুরে ঘুরে পড়লে মনে হয় দামোদর, অজয় নদের বালিভাসা বুক পার হয়ে পুরুষ প্রবেশ করেছে নগরে। নগরকে দখল করে নিয়েছে অতি অল্পকালেই। দখল করা অর্থে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করা। ১৩৫০-এর দুর্ভিক্ষ মন্বন্তর নিয়ে নগরের পটভূমিতে বদলি মঞ্জুর-এর লেখক লিখেছেন ধ্বংসপথের যাত্রী এরা- এই নামে এক তীব্র জীবন দহনের কাহিনী। নগর কলকাতা নিম্নবর্গের মানুষের কলকাতা। ব্যর্থ মানুষের শহর। এখানে এসে অজিত আশ্রয় নেয়। কাজের খোঁজে শহরে এসেছিল সে। সূত্র, গ্রাম সম্পর্কে পরিচিত এক ব্যক্তি রমেশ। শৈলজানন্দ আধা বস্তি অঞ্চলে কীটের মতো টিকে থাকা জীবনের যে ছবি এই গল্পে এঁকেছেন তার কখনও তুলনা হয় না। মেসবাড়ির বাসিন্দারা নানা পেশার মানুষ। জীবনের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গিও আলাদা-আলাদা। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, নিতান্ত স্বার্থপর নিষ্ঠুর ব্যক্তি মানুষের যে ছবি এই গল্পে রয়েছে তা পড়তে পড়তে টের পাওয়া যায় কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকদের। ন্যুট হ্যামসুন এবং ম্যাক্সিম গোর্কিকে এক জায়গায় মিলিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা। বাংলা ১৩৫০-এ যে লেখক লিখেছেন, তাঁকে তো ন্যুট হ্যামসুন তাঁর হাঙ্গার উপন্যাস নিয়ে ছেয়ে ফেলবেনই। শৈলজানন্দ, অচিন্ত্য, প্রেমেন্দ্রদের পড়তে গেলে ন্যুট হ্যামসুনের কথা মনে পড়ে যাবেই। কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। শৈলজানন্দ, অচিন্ত্য, প্রেমেন্দ্র যে দুর্ভিক্ষ, অভাব, কর্মহীনতা, মূল্যবোধ ভাঙার ছায়া এঁকেছেন তাঁদের গল্পে, তার ছবি ১৩৫০-এর দশ বছর আগে থেকেই দেখা যাচ্ছিল, এই ছবি আমরা জীবনানন্দের উপন্যাস জীবনপ্রণালী, জলপাইহাটিতে পেয়েছি। জীবনানন্দের কবিতায় পেয়েছি। পেয়েছি প্রেমেন্দ্র, অচিন্ত্যের গল্পে। প্রেমেন্দ্র মিত্রর সেই গভীর সংক্রমণের গল্প বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদের কথা মনে পড়ে যায় না কি?
শৈলজা, প্রেমেন্দ্র, অচিন্ত্য- তিন লেখকই যুদ্ধ মন্বন্তরের বঙ্গদেশকে চিনেছিলেন। তাঁদের লেখায় ওই সময়ের সামাজিক ইতিহাসকে যেন ধরা যায়। ধ্বংসপথের যাত্রী এরা গল্প থেকে এই বুভুক্ষুনগরের রূপকে চেনা যায়। শৈলজানন্দ লিখেছেন, কত রকমের, কত ভিক্ষুক- বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, যুবক-যুবতী, বালক, শিশু- কেউ কানা, কেউ খোঁড়া, ব্যাধিগ্রস্ত, অথর্ব, নিঃসহায়, নিরাশ্রয় দারিদ্র্যে নিপীড়িত, ক্ষুধায় আর্ত-আহারের জন্য উদগ্রীব হইয়া সকলে হাঁ-হাঁ করিতেছে। কাহারও অঙ্গে শতচ্ছিন্ন মলিন বস্ত্র- দুইদিন পরে তাহাতে আর লজ্জা নিবারণ হইবে কিনা সন্দেহ, আবার কাহারও বা সেই প্রাণান্তকর দুঃসময় আসিয়া পৌঁছিয়াছে দুর্ভাবনার প্রান্তসীমায় আসিয়া একেবারে মরীয়া হইয়া তাহারা যেন লজ্জাকে লজ্জা দিবার জন্যই অর্ধনগ্ন অবস্থায় দাঁড়াইয়া আছে। বিকৃত, রুক্ষ, কদাকার, কাহারও বা অস্থি-চর্মসার কঙ্কালের উপর ক্ষুধিত দুইটা জ্বলন্ত চোখের দিকে তাকানো যায় না। একটা গাছের তলায় রুগ্ন কঙ্কালসার একটা মেয়ে তাহার কোলের ছেলেটাকে স্তন্য দিতেছিল, কিন্তু প্রাণপণে চুষিয়াও একফোঁটা দুধ না পাইয়া ছেলেটা কাঁদিতে কাঁদিতে যতই চিৎকার করিতেছে, মেয়েটা ততই তাহাকে এ-কোল ও-কোল করিয়া তাহার দুগ্ধহীন স্তনের বোঁটাটা ছেলের মুখের ভিতর পুরিয়া দিয়া জোর করিয়া তাহাকে বুকের উপর চাপিয়া ধরিতেছে (ধ্বংসপথের যাত্রী এরা)।
নগরের এই ভয়ানক রূপের কথা শুনেছি নানা জনের কাছ থেকে। মায়ের কাছে শুনেছি। বিরল এক মধ্যাহ্নে মহাশ্বেতা দেবী, তৃপ্তি মিত্রের কথোপকথনে শুনেছি। শৈলজানন্দের লেখায় পড়েছি। ক্ষুধায়, অভাবে মানুষ কত অসহায়তা থেকে হিংস্র হয়ে ওঠে, স্বার্থপরতা মানুষকে কোন অন্ধকারে নিয়ে যায় তা তাঁর গল্প পড়তে পড়তে উপলব্ধির পর হিমশীতল অনুভূতিতে স্তব্ধ হয়ে থাকতে হয়। আজ থেকে সত্তর-পঁচাত্তর বছর আগের কলকাতা শহর কেমন ছিল, তার জনবিন্যাস, তার ঘরবাড়ি, পরিবহণ সব খুঁটিনাটিই শৈলজানন্দের লেখায় স্পষ্ট। তাই এখনও পড়তে ভালো লাগে। যে শহরকে দেখিনি অথচ সেই শহরেই বসবাস, এমন এক অদ্ভুত অনুভূতি চারিয়ে যায় শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের লেখার ভিতের প্রবেশ করলে। কয়লাকুঠির গল্পগুলি কয়লা খাদানে এসে বদলে যাওয়া আদিবাসী, নিম্নবর্গের মানুষের কথা। কৃষি থেকে উচ্ছেদ হয়ে এই মানুষগুলি হয়েছিল খাদানের কুলি। কিন্তু খাদানের অন্ধকার তাদের জীবনের সমস্ত আলো শুষে নিতে পারেনি। কয়লাকুঠির নানা গল্পের এখানে-ওখানে সেই সমস্ত চিহ্ন ছড়িয়েছিল। খাদানের জীবন তাদের পরব কেড়ে নিতে পারেনি। প্রেমকে মুছে দিতে পারেনি তা যেমন সত্য, তেমনি সত্য জীবনের শৃঙ্খলা ভেঙে দেওয়ার ঘটনাও। শান্ত জীবনটি যেন কয়লার আস্তরণে শ্রীহীন জীবন হিসাবে ধরা পড়েছিল, তেমনই ধরা পড়েছিল সেই শ্রীহীনতার ভিতর বেঁচে থাকা অদ্ভুত প্রেম, নরনারীর প্রগাঢ় অনুভূতি প্রেম। এই প্রেমে নারীই ত্যাগ করেছে বেশি, পুরুষ হয়েছে বহুগামী। জীবনের রসে ভরপুর কয়লাকুঠির জীবন শৈলজানন্দকে বাঁচিয়ে রেখেছে এতকাল। রাখবেও নিশ্চিতভাবে। শৈলজানন্দের গল্পে যেমন বিচিত্র পরিবেশ বিচিত্র জীবন, তেমনি মানুষের মনের অনেক বিচিত্র আলো-অন্ধকারও। কৃষ্ণা গল্পটির কথা ভাবা যাক। দুর্জ্ঞেয় মানুষ কাঙালিচরণ বড়ই অভাবী। অভাবে মেয়েটিকে এক বৃদ্ধর হাতে সমর্পণ করে। সেই মেয়েই কৃষ্ণা। বিধবা হয় কিন্তু বাবার কাছে ফেরে না। শেষে কাঙালিচরণ যখন মৃত্যুশয্যায়, কৃষ্ণাকে নিয়ে আসে প্রতিবেশী শুভানুধ্যায়ী। কাঙালি মারা যায়। শ্রাদ্ধশান্তি চুকলে প্রতিবেশীর গৃহিণী (দোতলাবাসী) সেই পুরোনো বাড়ির অন্ধকারে যেন মৃত কাঙালিচরণের ছায়া দেখে। কাঙালিচরণের নিজস্ব ঘরখানিতে তালা দেওয়া। সেই তালা কেউ যেন অন্ধকারে খোলে। শব্দটা টের পায় প্রতিবেশীর স্ত্রী। কৃষ্ণাও সায় দেয় প্রতিবেশিনীর কথায়, কাঙালিচরণ যেন আছে মৃত্যুর পরও। শেষে কাঙালিচরণের ঘরখানির তালা খোলা হয়। কৃষ্ণাই দেখায় বাক্স ভর্তি নোটের তাড়ায় ইঁদুর ঘুরছে। কাঙালিচরণ ওই টাকা রেখে মরেছে কিন্তু জীবিত অবস্থায় টাকার কথা কাউকে টেরও পেতে দেয়নি। জানত শুধু তার মেয়ে কৃষ্ণা। তীব্র অভিমানে সে বৃদ্ধ স্বামীর হাত ধরে ত্যাগ করেছিল বাবার সংসর্গ। অভাবে কাঙালিচরণ মরেছে। অভাবে কৃষ্ণার সর্বনাশও হয়েছে। কৃষ্ণা এখন উদ্ধার হওয়া নোটের তাড়ার উপর আছড়ে পড়ে কাঁদছে। মানুষের মনে কত অজ্ঞাত অন্ধকার, মানুষ কতভাবেই না বেঁচে সুখ পায়। তাড়া তাড়া নোট বাক্সবন্দি করে অভাবে মরে কাঙালিচরণ। মেয়েটাকেও ভাসিয়ে দেয়। মনে থেকে যাবে বহুদিন।
শৈলজানন্দের আরও বহু গল্পে আমরা দেখেছি ভয়ানক উদাসী বাস্তবতা। জীবনের প্রতি কি তীব্র নির্মোহ দৃষ্টি! আমি শৈলজানন্দের পাঠক হয়েই থেকে যাব। সরে যাওয়ার উপায় নেই।