অনিকেত চট্টোপাধ্যায়
২০১৮-র নভেম্বরে আমি রাশিয়ার ভলগোগ্রাদে। সেদিন ছিল নভেম্বর বিপ্লব বার্ষিকী দিবস। ছবিটা তুলেছিলাম দুপুর ৩টে ১০ মিনিটে। বিকেল ৪টে ৩৩ মিনিটে সূর্য ডুবে যাবে, সেখানে হাজির ছিলেন খুব বেশি হলে জনাদশেক, তিন-চারজন তরুণ, বাকিরা প্রবীণ। কিন্তু রাশিয়ার সর্বত্র নভেম্বর বিপ্লব বার্ষিকী উদযাপন হয়েছে। প্রায় প্রতিটি বড় শহরে লেনিন মূর্তির তলায় সমাবেশে কিছু হলেও মানুষ জড় হয়েছেন। হ্যাঁ, এই আজকের রাশিয়াতে স্তালিনের মূর্তি খুঁজে পেতে কয়েকটা পাওয়া যাবে। কিন্তু লেনিনের মূর্তি সর্বত্র, লেনিনের নামে রাস্তা, বিভিন্ন মিউজিয়ামে লেনিনের ব্যবহৃত জিনিসপত্র আছে, লেনিনের নামেই মেট্রো স্টেশন আছে, লেনিন স্কোয়ার আছে, লেনিন মুছে যাননি। মানুষের সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যাবে, তাঁদের রাগ, ঘৃণা, ক্ষোভ স্তালিনকে নিয়ে, কমিউনিস্ট পার্টিকে নিয়ে। কিন্তু লেনিন এখনও সেই ক্ষোভ, ঘৃণার বাইরে।
১০০ বছর হয়ে গেল লেনিন মারা গিয়েছেন, এখনও লেনিন বিভিন্ন দেশেই রাজনৈতিক আলোচনায় আছেন। হ্যাঁ, লেনিন এনেছে বিশ্বে জনস্রোতে অন্যায়ের বাঁধ, অন্যায়ের মুখোমুখি লেনিন প্রথম, প্রতিবাদ গোছের আবেগ নেই। বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই লেনিন, এরকম উচ্চারণ শোনা যায় না। কিন্তু রাজনৈতিক আলোচনা হলে তিনি এসে পড়েন টুক করে। কারণ একটা নয়, অনেক।
ফেব্রুয়ারিতে বিপ্লব হয়েছে, জার পালিয়েছে তার শীতপ্রাসাদ ছেড়ে, মেনশেভিকদের নেতৃত্বে কেরেনেস্কি সরকার তৈরি হয়েছে। কিন্তু না শ্রমিকরা খুশি, না কৃষকরা। কৃষকরা চেয়েছিল নিজেদের জমি, কিন্তু জমি তো কুলাকদের হাতে, আর কারখানার শ্রমিকরা দেখল ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পরেও কারখানাতে বসে রয়েছে পুরোনো মালিকরা। মার্চ মাসে বলশেভিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে লেনিন অভ্যুত্থানের ডাক দিলেন, অধিকাংশ নেতা এই ডাককে সময়োচিত নয় বললেন। কামেনভ, জিনোভিয়েভ-এর মতো নেতারা বিরোধিতা করলেন, লেনিন দলে সংখ্যালঘু, কিন্তু তিনি বলে যেতে থাকলেন এবং দল তা মেনে নিল, অভ্যুত্থান হল। কিন্তু সফল অভ্যুত্থানের পরেও কামেনভ জিনোভিয়েভ এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। কেন বলছি একথা? বলছি এটা বোঝানোর জন্য যে দলে সংখ্যালঘু মতামতের জায়গা ছিল, জায়গা না থাকলে লেনিনকে অন্য দল তৈরি করতে হত। জিনোভিয়েভ, কামেনভের গর্দান যেত। যায়নি। এই বিপ্লবের আগেই রাশিয়ার বিভিন্ন সোভিয়েত চলে এসেছে বলশেভিকের দখলে, এই সোভিয়েতের নির্বাচনে, দক্ষিণপন্থী বিপ্লবীরা ছিলেন, যাঁরা বলশেভিকদের ঘোর বিরোধী ছিলেন, পরবর্তী সময়ে এঁরা জারপন্থী হোয়াইট আর্মিকে সমর্থন জুগিয়েছিলেন। ছিলেন বাম বিপ্লবীরা, যাঁরা বলশেভিকদের নেতৃত্ব মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। পরবর্তীতে এঁরা নৈরাজ্যবাদে নেমেছিলেন, সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়েছিলেন। ছিলেন মেনশেভিকরা, এঁরা অক্টোবর বিপ্লবের পরে ক্ষমতা হারিয়ে বলশেভিকদের পতনের অপেক্ষা করছিলেন।
লেনিনের নেতৃত্বে ১৯১৭-র বলশেভিক বিপ্লবের পরেও বিভিন্ন দল আর রাজনৈতিক মতামত ছিল, সংখ্যালঘু মতামতকে স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা ছিল না। বিপ্লবের পরে লেনিন একদলীয় শাসন চালু করেছিলেন বলে যে প্রচার আছে তা ঠিক নয়, চূড়ান্ত অসত্য। ১৯১৭-তে বিপ্লব হল, মানুষ কী পেলেন? বা বলা ভালো কী পেতে চলেছেন বলে মনে করলেন? শ্রমিকরা পেলেন কারখানা চালানোর পূর্ণ ক্ষমতা, হ্যাঁ কারখানা মালিকরা সেদিন থেকে হয় শ্রমিক হলেন, নাহলে পালিয়ে গেলেন। ত্রয়কা বলে এক কাঠামো তৈরি হল, যেখানে শ্রমিকরা ম্যানেজমেন্ট-এর বিরুদ্ধে হরতাল করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। মানে বিপ্লবের পরেও শ্রমিকদের হরতাল করার অধিকার মেনে নেওয়া হল। আমাদের দেশে কমিউনিস্ট পার্টির এক পলিটব্যুরো সদস্য দল হরতালের ডাক দেয় বলে যারপরনাই লজ্জা পেতেন, নিজেই জানিয়েছিলেন।
ওদিকে কুলাক ভূস্বামীদের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে জমির মালিকানা, জমি বিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে কৃষকদের মধ্যে। এতদিনে খেতমজুরের জমির খিদে মিটছে। কাজেই সেই সময়কার রাশিয়ার সব থেকে বড় অংশ, শ্রমিক আর কৃষকরা অচ্ছে দিনের হদিস পেলেন। পেলেন কারণ অক্টোবর বিপ্লবের আগে থেকেই বলশেভিক বিপ্লবীরা একটা একটা করে সোভিয়েতের ক্ষমতা নিয়েছেন, কারখানার মালিকরা পালিয়েছেন, পালিয়েছেন ভূস্বামীরা। কবে থেকেই তো শ্রমিকরা জার বিরোধী ছিল, কিন্তু কৃষকরা? তাঁদের ঘর থেকেই জারের সেনাদলে যোগ দিতেন কৃষক সন্তানরা, কৃষকরা ছিলেন জারের অনুগত। কিন্তু সেই আনুগত্য চলে গেল জমির সম্ভাব্য মালিকানা আসার আশায়, কিছু কিছু জায়গায় জমির মালিকানা পেলেন কৃষকরা। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার তুলে নেওয়ার রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত, লেনিনের সেই ডিক্রি তখনও কৃষকরা অনুধাবন করতে পারেননি। তাঁদের মনে হয়েছিল, তাঁদের বোঝানো হয়েছিল যে বড় জমিদার সামন্তদের জমি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, ছোট কৃষকদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার জন্য। মানে এই ডিক্রি জারির সঙ্গে সঙ্গেই একটা সমস্যা তৈরি হয়েই থাকল। যা পরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। এর সঙ্গে সারা বিশ্বকে চমকে দিয়ে নারী সহ সর্বজনীন ভোটাধিকার চালু হল, কেবল তাই নয়, তার সঙ্গে দেওয়া হল রাইট টু রিকল, জনপ্রতিনিধিকে ফিরিয়ে আনার অধিকার।
পরের দিকে নানা ঘাতপ্রতিঘাতে ছবিটা পালটাল। লেনিন বারবার লিখছেন আমলাতন্ত্র পার্টিকে গ্রাস করছে, কিন্তু দল তখন ধীরে ধীরে স্তালিনের হাতে যাচ্ছে, ট্রটস্কি ইতিমধ্যেই কোণঠাসা। বড় কৃষক আর কারখানার মালিক ইত্যাদিরা বুঝে ফেলেছেন হাওয়া কোনদিকে। এই সময়েও লেনিন চেষ্টা করেছিলেন স্তালিনকে সরিয়ে দলে আবার গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার। তিনি সরাসরি স্তালিনকেও চিঠিতে লিখছেন যে স্তালিন যেভাবে তাঁর স্ত্রী স্ক্রুপস্কায়াকে অপমান করেছেন তা মেনে নেওয়া যায় না, এটা তিনি তাঁর অপমান বলেই মনে করছেন। তিনি এই একই চিঠি লিখছেন ট্রটস্কিকেও, তাঁকে জানাতে যে দলে কী চলছে। লেনিন স্তালিনকে দায়িত্ব দিতেই নারাজ ছিলেন। অন্তত তাঁর শেষ ইচ্ছের কাগজ তো সেরকম বলছে। কিন্তু সেসব করার আগেই ১৯২৪ সালের জানুয়ারিতে লেনিন মারা গেলেন।
লেনিনের যাবতীয় ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাঁকে ঘিরে এক ব্যক্তিপুজোর সূত্রপাত সেদিন থেকেই, লেনিন ম্যুসোলিয়ামে লেনিনের মরদেহ রাখা ছিল তার সূত্রপাত। লেনিনের বিভিন্ন রচনা হয়ে উঠল অবশ্য পাঠ্য, কিন্তু তার প্রয়োগ বন্ধ হল। সারাটা জীবনজুড়ে যে মানুষটি দলের মধ্যে বাইরে গণতন্ত্রের জন্য লড়েছেন, সেই মানুষটিকে সামনে রেখেই গণতন্ত্রের সাধারণ ধারণাও মুছে দেওয়া হল। অনায়াসে একজন বলতে পেরেছেন, আমি ভদ্রলোক নই, আমি কমিউনিস্ট। অনায়াসে পৃথিবীর বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী-নেতাদের কাছে খবর পৌঁছে গেল, যে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা, শাসন মানেই এক দলের শাসন, কমিউনিস্ট শাসন মানেই ধর্ম, চার্চ, মন্দির, মসজিদের উচ্ছেদ।
পৃথিবীর কোন এমন দেশ আছে যেখানে একটা লেনিন মূর্তি নেই? কিন্তু লেনিনের পরে বিপ্লব হয়েছে, কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতা দখল করেছে এমন প্রত্যেক জায়গাতে গণতন্ত্র উপেক্ষিত, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চূড়ান্ত অবহেলা আর গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণাকে ভুলে যাওয়াটাই আমরা দেখেছি। এক ওভারকোট পরা, উচ্চ শির মূর্তি পৃথিবীর সর্বত্র দাঁড়িয়ে তো আছে, কিন্তু তাঁর ধ্যানধারণার সমাধি বহুকাল আগেই ঘটে গিয়েছে। রুশ দেশের কমরেড লেনিন সত্যিই পাথরের কবরে শয়ান।
(লেখক পরিচালক ও সাংবাদিক)