Sunday, May 19, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়এই মুগ্ধ বাঙালির কাছে কী প্রত্যাশা করব?

এই মুগ্ধ বাঙালির কাছে কী প্রত্যাশা করব?

  • পবিত্র সরকার

এই লেখক এমন একটা বয়সে পৌঁছেছে যখন তার অবস্থান প্রত্যাশার প্রান্তে বা কার্নিশে-এ রকম বলাই যায়। ক্রমশ এ পৃথিবীটাই তার কাছে অস্পষ্ট হয়ে আসছে-যেমন অস্পষ্ট হয়ে আসছে পৃথিবীর কাছে-আর এই পৃথিবীর যে ক্ষুদ্র অংশ বাঙালি, সে তো আরও অস্পষ্ট ও প্রশ্নসংকুল। লেখক না হয় মৃত্যুর ছায়াবেষ্টনীর মধ্যে এসে পৌঁছেছে, তার কাছে আর কিছু প্রত্যাশা করার নেই। কিন্তু বাঙালি যে জাতি-কী বেঁচে আছে, ভাবছে, বা ঋত্বিক ঘটকের ভাষায়-ভাবা প্র্যাকটিস করছে? তা যদি হয় তাহলে গত দেড়-দু’বছর তাকে এমন দুর্গতির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে কেন, যেখানে মানুষের প্রত্যাশা করার সাহসও লুপ্ত হয়ে যায়?

বাঙালি নামটা প্রশ্নসংকুল একটা সহজ অর্থে: কোন বাঙালি, কোথাকার বাঙালি? বাঙালি ভূমিপুত্রকন্যারাও তা নানা রাজনৈতিক ভূগোলে বিভক্ত। তার বৃহত্তর সত্তা আছে বাংলাদেশে, যেখানে বৎসরের শুরুতেই একটি নির্বাচন হতে যাচ্ছে। প্রত্যাশা করব এই নির্বাচনে শেখ হাসিনাই জয়ী হবেন, তাঁর বিরোধী মৌলবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাবিরোধী শক্তি পরাভূত হবে। বাংলাদেশের একটি অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ভাবমূর্তি অব্যাহত রাখার জন্য শেখ হাসিনার কোনও বিকল্প আমি ভাবতে পারছি না। তাঁর প্রশাসনে বাংলাদেশের, আমার জন্মভূমির, নানা ক্ষেত্রেই অগ্রগতি ঘটেছে, পৃথিবীর সবচেয়ে দাম্ভিক আর প্রতাপান্বিত রাষ্ট্র আমেরিকার মুখে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে তা নিজের স্বপ্নপূরণে এগিয়ে চলেছে, তার জন্য আমি এটুকু প্রত্যাশা করতেই পারি-তার মূল্য যাই হোক।

ভূমিপুত্রকন্যারা আরও আছে ত্রিপুরায়, অসমে, ঝাড়খণ্ডে, বিহারে, আন্দামানে; কোথাও কোথাও অভিবাসী থেকে ভূমিজ। তাঁদের প্রত্যাশার সঙ্গে আমার প্রত্যাশা নাও মিলতে পারে, কারণ যে অঞ্চলে বা সমাজপ্রতিবেশে তাঁরা বাস করেন তা তাঁদের প্রত্যাশার একটা আলাদা জমি তৈরি করে দেয়। আমি শুধু বলব, তাঁরা নিজেদের ভাষা নিয়ে সুখে থাকুন, প্রতিবেশ যেন তাঁদের সঙ্গে প্রতিকূলতা না করে, অখণ্ড ভারতের নাগরিক হিসেবে তাঁরা সেখানে সবরকমের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে বাঁচুন, এগিয়ে যান।

পৃথিবীর নানা ধনী দেশজুড়ে এখন বাস করছে অভিবাসী এক বিরাট বাঙালি সম্প্রদায়, তাদের প্রত্যাশা, আর আমাদের গরিবদেশগুলির বাঙালিদের প্রত্যাশাও কি এক হবে? আমি তাই একরকম মস্তিষ্কের ঝামেলার মধ্যে পড়ে গেছি, কাদের কাছে কী চাইব, কারা আমাকে কী আশ্বাস দিতে পারবে। বুদ্ধের মতো হাতের বরাভয় মুদ্রা তৈরি করে বলবে, ঠিক আছে, ঠিক আছে-তুমি যা হাতিঘোড়া চাও সব দেব, সব হবে।

আমে এই পশ্চিমবঙ্গ (উত্তরবঙ্গ+দক্ষিণবঙ্গ) নামক ভূগোলে যারা বাস করবে, তাদের কাছে প্রত্যাশা করব, না সব বাঙালির কাছে প্রত্যাশা করব। পাঠকরা এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে, সব বাঙালি এক দরের নয়। আমি যদি ইংল্যান্ড-জাপান-আমেরিকার বাঙালির কাছে বলি, ওগো তোমরা দেখো তো আমাদের ভূখণ্ডের যে বিপুল দুর্নীতি হয়ে গেল চাকরি নিয়ে, র‌্যাশন নিয়ে, আবাসটাবাস সব হাজার রকম যোজনা নিয়ে এ বছরে সেটা বন্ধ করা যায় কি না! তারা বলবে, দূর! ও সব তোমাদের ব্যাপার! তোমরাই ভোট দিয়ে একটা সরকারকে বসিয়েছ, তোমাদের হ্যাপা তোমরাই সামলাও, আমাদের এর মধ্যে ডাকছ কেন? আমরা তো এ সব এড়াব বলেই দেশ থেকে ভেগেছি, দিব্যি সুখে আছি! তোমরা তোমাদের মাথাব্যথা নিয়ে থাকো।

ফলে একদল বাঙালি নিজেদের হাত ধুয়ে ফেলবে তাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশার কথা বলতে গেলে। কিংবা এত নিষ্ঠুর যদি নাও হয়, মুখে ‘চুকচুক’ আওয়াজ করে বলবে, কী করব বলো, এত দূরে থেকে আমাদের পক্ষে কিছু করা তো আর সম্ভব নয়। আমরা ভূগোলের বেড়ায় আটকে গিয়েছি। অগত্যা আমাদের কাছেপিঠের বাঙালির দিকেই আমরা মুখ তুলে তাকাই। দেখি সবাই উৎসবে মেলায় মেতেছে। শহরে ভীষণ-ভীষণ উজ্জ্বলতা, রংবেরঙের টুনিবালবে ছয়লাপ, গাছপালা, বাড়িঘর সব টুনিবালবে ছেয়ে আছে। চন্দননগরের আলোকশিল্পীদের আলোকসজ্জায় রংবেরঙের ছবি নাচছে, হাসছে, ডিগবাজি খাচ্ছে-সান্তাক্লজ ব্যাগ ভর্তি করে দৌড়োচ্ছে, সার্কাসের ক্লাউনেরা ভেংচি কাটছে- মেলা-মোচ্ছব চতুর্দিকে-এতে তো মনে হয় সবাই সবকিছু পেয়েই গিয়েছে, প্রত্যাশা করার আর কী বাকি আছে? যেন আমরা পৌঁছে গিয়েছি কোনও এক ‘সব পেয়েছির দেশ’ বা এল দোরাদো-তে, দুয়ারে সবকিছু, আর কিছু পাবার বাকি নেই। এই মুগ্ধ বাঙালির কাছে কী প্রত্যাশা করব? আমি যদি বলি, হে বাঙালি, তুমি কি সেই পরিযায়ী বাঙালি শ্রমিকের দুঃখের কথা জানো, যে মালদা-মুর্শিদাবাদ বা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার গ্রাম থেকে চলে যাচ্ছে গুজরাটে, মহারাষ্ট্রে, তামিলনাডুতে কর্ণাটকে-তার ঘরে একটা চাকরি বা রোজগারের ব্যবস্থা করতে পারো এই নতুন বছরে? সে আমাকে মুখঝামটা দিলে তখন কে তাকে আটকাবে? সে উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বলবে, মরে যাই, মরে যাই! চাকরি দেবার আমি কে হে! আর সবাই যদি ঘরের গরম ভাত খেয়ে চাকরি করবে, তাহলে বাকি দেশটার কী হবে? যদি আমি এই বাঙালিকে বলি, যে এই যে চাষিরা ঋণের দায়ে এত আত্মহত্যা করছেন বা চা বাগানের মজুররা, এ ব্যাপারে তোমরা কিছু করতে পারো? তারা বলবে, পাগল নাকি! আত্মহত্যা কে বলে? কেউ মরছে আন্ত্রিকে, কেউ অজানা পেটের রোগে-তুমি সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কাছে যাও-আমাদের কাছে এসেছ কী করতে?

কিংবা যদি বলি, এই যে লেখাপড়া ডকে উঠতে বসেছে, প্রচুর স্কুল বন্ধ হয়ে গিয়েছে, মাস্টার নেই হাজার হাজার ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে আসতে চাইছে না, স্কুলের দপ্তরি প্রাইমারি স্কুল চালাচ্ছে, কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে কী হচ্ছে আর কী হচ্ছে না তার মাথামুণ্ডু নেই, রাজ্যপাল আর শিক্ষা দপ্তরে ধুন্ধুমার লেগেছে, ফলে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এখন-তখন অবস্থা-তখন হে বাঙালি, তোমার কাছে কী প্রত্যাশা করতে পারি!

বাঙালি ফরাসি কায়দায় ‘শ্রাগ্’ করে, অর্থাৎ দুই কাঁধ একটু উঁচু করে আবার ফেলে দিয়ে ইংরেজিতে বলবে, ‘ওঅট্ দ্য হেল্, হাউ ডু আই নো !’ এর পরে আমারও আর এই কথা বলবার সাহস হবে না যে, এই যে বাংলাভাষাটা ইংরেজি আর হিন্দির দাপটে কুঁকড়ে যাচ্ছে, বাপ-মায়েরা অলীক স্বপ্নে বাচ্চাদের সব ইংলিশ মিডিয়ামে গুঁজে দিচ্ছে, সে সব স্কুলে নাকি বাংলা বললে শাস্তি দিচ্ছে-এর একটা বিহিত, হে বাঙালি, তুমি করতে পারো কি?

বাঙালি বলবে, অত বাংলা-বাংলা কোরো না তো! বাংলা-ফাংলা দিয়ে কী ঘোড়ার ডিম হবে। যেমন চলছে চলুক। এতেই উন্নতি, এতেই পোগোতি, এতেই আমাদের স্বর্গলাভ!

এই বাঙালির কাছে আমি কী প্রত্যাশা করব? জানি না বাঙালির মধ্যে কোনও ফেরারি ফৌজ তৈরি হচ্ছে কি না, যারা সব বদলে দিতে আসবে।

(লেখক সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Money Seized | ফের উদ্ধার টাকার পাহাড়! আয়কর দপ্তরের নিশানায় এবার কারা?

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: এ যেন টাকার পাহাড়! তিন জুতো ব্যবসায়ীর (Show traders) বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা উদ্ধার (Money seized) করল আয়কর...

Narendra Modi | ‘সন্তদের অপমান দেশ মেনে নেবে না’, মমতার মন্তব্যের কড়া জবাব মোদির

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ‘ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ, রামকৃষ্ণ মিশন এবং ইসকনের সন্তদের অপমান দেশ মেনে নেবে না।’ রবিবার পুরুলিয়ায় (Purulia) নির্বাচনি সভা (Vote Campaign)...
Suffering from foot pain? Do these 3 exercises regularly

পায়ের ব্যথা ভোগাচ্ছে? নিয়ম করে এই ৩টি ব্যায়াম করুন…

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: অল্প বয়স থেকেই পায়ের ব্যথায় ভুগছেন? ২৫-এর তরুণী হোক বা পঞ্চাশোর্ধ্ব প্রৌঢ়। এই পায়ের ব্যথায় অনেকেই জর্জরিত। পায়ে যন্ত্রণার বিভিন্ন...
Liquor-gambling party under Mahananda bridge

Siliguri | মহানন্দা সেতুর নীচে মদ-জুয়ার আসর, ক্ষোভ বাসিন্দাদের

0
শিলিগুড়ি: পুলিশের নাকের ডগায় বসেছে জুয়ার আসর। শিলিগুড়ির(Siliguri) এয়ারভিউ মোড় সংলগ্ন মহানন্দা সেতুর(Mahananda Bridge) নীচেই দিনেদুপুরে চলছে জুয়ার আসর। অভিযোগ, প্রতিদিনই সকাল থেকে মহানন্দা...

Siliguri | বৃষ্টিতে ডেঙ্গির প্রকোপ বাড়ার শঙ্কা, নজরদারি বাড়াচ্ছে পুরনিগম

0
রাহুল মজুমদার, শিলিগুড়ি: বৃষ্টি নিয়ে দোলাচলে শিলিগুড়ি (Siliguri) পুরনিগমের দুই দপ্তর। জল সংকটের মাঝে বৃষ্টিতে ক্ষণিক স্বস্তি নিগমের জল সরবরাহ বিভাগ। কিন্তু এই বৃষ্টিতে...

Most Popular