- উত্তম সেনগুপ্ত
রাম ফিরলেই যে ‘রামরাজ্য’ ফিরবে তা অর্থহীন। যদিও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ও ভারতীয় জনতা পার্টির স্বপ্নের রাম মন্দির অযোধ্যায় উদ্বোধন হচ্ছে।
‘রামরাজ্য’ একটি পরিকল্পিত সাম্রাজ্য। যেখানে অহিংসা ও সাম্যবাদই নয়, রাজ্যবাসীর সবার সমানাধিকার। তাঁরা নির্ভয়ে রাজ-সমালোচনা করার অধিকারী। রাজাকে তাঁরা প্রশ্নও করতে পারেন। তুলসীদাসের রাম-কথায় যা বলা হয়েছে, অনেকটা সেরকম। পারস্পরিক সম্মান ও প্রীতিরও দেখা মেলে সেখানে। এটা এমনই এক রাজ্য, যেখানে ন্যায় ও সত্যের প্রাধান্য। এখানে স্ত্রী, আত্মীয়স্বজনের কথা পরোয়া করেন না রাজা। তাঁর কাছে প্রজারাই আসল। কিন্তু আজকের অযোধ্যা ও ভারত স্পষ্টতই রামরাজ্যের এই আদর্শবাদী ধারণা থেকে বহু দূরে।
রামরাজ্যের এমন ধারণাকে ফুটিয়ে তুলতে চায়নি কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। সাধারণ মানুষের বিশ্বাসকে উৎসাহিত করতে ও উন্নয়নের দেখনদারির জন্য ধর্মীয় পর্যটনে দেশ পিছিয়ে বলে মনে হচ্ছে। ধর্মীয় পর্যটনের প্রচারে অযৌক্তিক সরকারি ব্যয়ের সর্বশেষ উদাহরণ অযোধ্যা। পর্যটন নিঃসন্দেহে স্থানীয় অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে। হোটেল ও পরিবহণ কর্মসংস্থানের সহায়ক। নয়া নির্মাণ ও পরিকাঠামো তৈরি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রভাব বিস্তারের পাশাপাশি আয়ের উৎসমুখও খুলে দেয়। তবে এসব অতি সাধারণ বিকল্প। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, পরিস্রুত পানীয় জল ও যথাযথ পরিবেশ তৈরির আগে এমন পর্যটনে জোর দেওয়া ভুল অগ্রাধিকার বলে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
মন্দির তৈরি, ধর্মীয় পর্যটনের সুবিধা ভালো চাকরি ও শিক্ষার উন্নতিতে ভালো কাজ করে না। অমরনাথ, বৈষ্ণোদেবী, চারধাম যাত্রা, কুম্ভমেলা ও কাশী করিডর এর উদাহরণ। আরও ছোট উদাহরণ বিজেপি শাসিত রাজ্যে উজ্জয়িনীর মহাকাল করিডর। এসব যাত্রার প্রচারে সরকারি অর্থের ব্যয় যথেষ্ট সন্দেহজনক। রাম মন্দির ঘিরে অযোধ্যার বদল এপর্যন্ত সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা। এব্যাপারে শংকরাচার্যদের মন্তব্য তাৎপর্যময়। তাঁরা বলেছেন, কেন্দ্রীয় সরকার ‘তীর্থস্থল’কে ‘ভোগস্থলে’ রূপান্তরিত করছে।
মন্দির উদ্বোধনের আগে অযোধ্যা থেকে যেসব রিপোর্ট আসছে তাতে ইঙ্গিত মিলছে ভিক্ষুক, হকার ও গরিবদের অযোধ্যা থেকে সরানো হয়েছে বা হচ্ছে। অমিতাভ বচ্চনের মতো সেলেব্রিটিদের জন্য হোটেল বা সাততারা অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি। ইতিমধ্যে বিগ-বি সেখানে ১৪ কোটি টাকায় জমিও কিনেছেন। অনেকেই আছেন, যাঁরা আর্থিক দিক থেকে সচ্ছল নন। তবে নজর অনেক উঁচুতে। পুরো ঘটনাটা এঁদের টানতে পারে। তবে বিশ্বাসের বাণিজ্যিকীকরণের দিক থেকে কুৎসিততম উদাহরণ।
ইতিমধ্যে কেন্দ্র ও রাজ্যের তরফে ‘পবিত্র শহর’-এর উন্নয়নে আনুমানিক ৩০ হাজার কোটি টাকা খরচের পরিকল্পনা করা হয়েছে। নতুন রূপের অযোধ্যা রেলস্টেশন ও বিমানবন্দরের জন্য নানা মিডিয়ার হিসেবে প্রায় দু’হাজার কোটি টাকা ইতিমধ্যে খরচ হয়েছে। মন্দির শহরটির সরকারি খরচের হিসাব খুবই রহস্যময়। আশা করা হচ্ছে, ক্যাগ খুব দ্রুত হিসেবগুলি খতিয়ে দেখবে।
রাম মন্দিরের উন্মাদনা এমন জায়গায় যে, এক ভক্তের কাছ থেকে হাজারটি রুপোর পদ্ম, অন্যজনের কাছ থেকে সোনার ইট দান করার কথা মিডিয়ায় ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে। ইডি এমন দানের বিষয়টি ঠিকমতো নজর করেছে কি না সেটা এখনও স্পষ্ট নয়। এই দান আরএসএসের সময়োচিত ঐতিহ্য অনুযায়ী ‘গোপন’ থাকবে। একটি ভাইরাল ভিডিওতে ট্রাস্টের সম্পাদক চম্পত রাইকে বলতে শোনা গিয়েছে, মন্দিরের প্রতিটি সোনার প্রলেপ দেওয়া দরজার দাম পড়েছে ৬০ কোটি টাকা। এমন বাড়াবাড়ি খরচ এড়ানো যেত কি না, এই অর্থ আরও ভালোভাবে খরচ করা যেত কি না, এ নিয়ে নেতাদের প্রশ্ন করা অবশ্যই বৃথা চেষ্টা।
মহাত্মা গান্ধি বলেছিলেন, ‘আমার রাম, আমাদের প্রার্থনার রাম, অযোধ্যার রাজা ঐতিহাসিক রাম নন। তিনি চিরকালীন, আজন্ম, এক মুহূর্তহীন। তাঁকে ঈশ্বর, আল্লা, গড যাই বলুন না কেন, তাঁর অগুনতি নাম। তিনি সময়হীন, আকারহীন। তাঁকে আমি একা উপাসনা করি।’ হিন্দুরা যে রামকে পুজো করে তা অভিন্ন। এটি শুধুমাত্র এক আলংকরিক পৌরাণিক কাহিনী নয়, এটি আধ্যাত্মিক, দার্শনিক ও নৈতিক শিক্ষার একটি গভীর ব্যাখ্যা। এটি আমাদের সভ্যতাকে নানাভাবে সাহায্য করেছে।
আরএসএসের সংখ্যালঘু সেল মুসলিম রাষ্ট্রীয় মঞ্চের দাবি, দেশের ৭২ শতাংশ মুসলমান নাকি রাম মন্দির তৈরিতে খুশি। কিন্তু তখন তাঁদের মনে অন্য রাম ছিল। সংঘ পরিবারের কল্পনার রাম একজন ক্রুদ্ধ যোদ্ধা। যিনি মানবতা নয়, হিন্দু ও হিন্দুত্বকে রক্ষা করবেন।
শুধুমাত্র ভারত নয়, দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানদের একটা প্রজন্ম রামলীলার অভিনয় দেখে বড় হয়েছে। শুধু তাই নয়, তাঁরা প্রবল উৎসাহে এতে অংশও নিয়েছেন। নতুন রামভক্তরা অবশ্য এই মহাকাব্যের পারিপার্শ্বিক ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং সাহিত্যমূল্য জানেন না। এঁরা বলিউডের প্রখ্যাত অভিনেতা নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীকে রামলীলায় মারীচের ভূমিকায় অভিনয় করতে দেননি। উত্তরপ্রদেশে বহু গ্রাম আছে যেখানে মুসলমানরা রামলীলার ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। এজন্য অর্থসাহায্য থেকে শুরু করে অভিনয় বা অন্য কাজে লোক জোগাড় তাঁরাই করেন।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার পাশাপাশি থাইল্যান্ড, বালি, কম্বোডিয়া সহ নানা স্থানে বৌদ্ধ ও মুসলিমদের রামায়ণভিত্তিক ব্যালে এখনও পরিবেশিত হয়। ১৯৪৯ সালে বেলজিয়ামের যাজক ক্যামিয়েল বালকির ‘রামকথা-অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’-এর উপর অসামান্য কাজ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রামায়ণের শতাধিক ‘সংস্করণ ও ব্যাখ্যা’ খুঁজে পেয়েছে।
অযোধ্যার প্রস্তাবিত মেগা ইভেন্টে মুসলমানদের প্রতীকী উপস্থিতি সত্ত্বেও উত্তরপ্রদেশ সহ দেশের অন্যত্র মুসলিমদের বড় অংশ ওইদিন নিজেদের ঘরবন্দি রাখতে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়েছে। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলিতে তাঁরা ঘরের বাইরে যাওয়ার বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক পরামর্শ দিচ্ছে। উন্মত্ত সহিংস জনতার শিকার হওয়ার অতীত অভিজ্ঞতা ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের নানাবিধ দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য এবং রাম মন্দির উদ্বোধন রুখতে সন্ত্রাসী হামলা চালানোর পরিকল্পনার খবর তাঁদের উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে। উত্তরপ্রদেশের যমজ শহর অযোধ্যা-ফৈজাবাদের মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ। অযোধ্যাবাসী সহ হিন্দু-মুসলিমদের ঘরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
রাম বিশ্বাসীদের বড় অংশের বিস্মিত প্রশ্ন, কেন অযোধ্যার রাম মন্দির রামনবমীর শুভক্ষণ বা দশেরা অথবা দীপাবলিতে উদ্বোধন করা হল না? এক বা দুজন শংকরাচার্য তাড়াহুড়ো করে উদ্বোধন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের দাবি, মন্দির অসম্পূর্ণ। ২০২৫-এ কাজ শেষ হবে। তাই অসমাপ্ত মন্দিরে দেবতা স্থাপন ধর্মশাস্ত্র বিরোধী।
বেশিরভাগ মানুষ, মিডিয়া ও রাম বিশ্বাসীরা জানেন, রাম বিশ্বাসের সঙ্গে এই মন্দিরের সম্পর্ক খুবই কম। বরং রাজনীতির সঙ্গে এর গভীর সম্পর্ক। চার বছরে নির্মিত একটি অসম্পূর্ণ ‘নয়া অযোধ্যা’য় তাড়াহুড়ো করে অসম্পূর্ণ মন্দিরের উদ্বোধনের কারণ, লোকসভা নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে। সম্ভবত বিজেপি আর অপেক্ষায় নারাজ। কারণ, ততদিনে মডেল কোড অফ কনডাক্ট চালু হয়ে যাবে। জোরকদমে চলবে লোকসভা ভোটের প্রচার। ৮০টি লোকসভা আসন সহ উত্তরপ্রদেশ তাই বিজেপির কাছে আসন্ন নির্বাচনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাম মন্দিরের গাজোরে ৮০টি আসনেই জেতার আশা দলের।
নির্বাচনি প্রকৌশলী প্রশান্ত কিশোর অবশ্য বিশ্বাস করেন না রাম মন্দির লোকসভা ভোটে বড় ইস্যু হবে। তিনি প্রকাশ্যেই বলেছেন, বিজেপি ইতিমধ্যেই রাম রথে চড়ে বেশ কয়েকটি নির্বাচনে জিতেছে। কিন্তু রাজনীতিতে একই ইস্যু বারবার জিততে সাহায্য করে না। তিনি মণ্ডল কমিশনের কথা উল্লেখ করে বলেন, এই আন্দোলন বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংকে প্রধানমন্ত্রীর কুর্সি দিয়েছিল। আন্না হাজারের লোকপাল এবং দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন অতীতে বিজেপির পালে হাওয়া দিয়েছিল। সেগুলি সবই এখন বাষ্প হয়ে উবে গিয়েছে। দেখা যাক, রাম মন্দিরের রেশ কতদিন থাকে।
(লেখক টাইমস অফ ইন্ডিয়ার প্রাক্তন রেসিডেন্ট এডিটর)