রূপায়ণ ভট্টাচার্য
গাছপালায় ঢাকা কবরখানার মাঝখান দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে এমন এক অনুভূতি বাসা বাঁধে, যার ভাষা লুকিয়ে থাকে শুধু আকাশে। স্মৃতি ও মাটি প্রতি পলকে বলে দিয়ে যায়, এখানে রয়ে গিয়েছে আভিজাত্য-দারিদ্র্য, প্রেম-বিরহ, আনন্দ-যন্ত্রণার রাগমালা। গাছে গাছে কথা বলে, কবরে কবরে, গাছে ও কবরেও।
কলকাতার এক প্রান্তে গোবরা কবরখানায় অনন্ত নিদ্রায় শুয়ে রয়েছেন গায়ক সম্রাট আমির খান। আরও একটু দূরে পিতা এনায়েত খানের পাশে সেতার সম্রাট বিলায়েত খান। এখানে সুরবাহার খেলা করে।
কথা ছিল, কলকাতার দক্ষিণে টালিগঞ্জ গোরস্থানে শেষশয্যা নেবেন বর্তমান সম্রাট রাশিদ খান। তেমন হলে মহানগরীর সুর-সুরমার রোমান্টিকতা অন্য আকাশে পৌঁছাত হয়তো। দু’প্রান্তে সুরধ্বনি শেষপর্যন্ত দেশ বা ললিতে বা মালকোষে বিস্তার তুলত দিনের প্রহর বুঝে। সুরবিজয়ের কেতন উড়ত নীরবে, নিভৃতে। ৪৫ বছর কলকাতায় থেকে বাঙালি হয়ে ওঠা রাশিদের দেহ হঠাৎই বদাউনে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তা হল না আর। অতৃপ্তি থেকে গেল। তবু বারবারই প্রতিভার সমুদ্রে মসৃণ ভেসে যাওয়া রাশিদের কথা উঠলে বাকি ত্রয়ীর কথা ভেসে ওঠে। একশা হয়ে যায় অনন্ত সৃজনশীল প্রজ্ঞা। মাঝে মাঝে ভাবতে হয়, কী ঐশ্বরিক সুরের সাক্ষী হয়ে গর্বোদ্ধত হওয়ার অধিকার ছিল কলকাতার।
এনায়েত-বিলায়েতের ঘরানা এটাওয়ার, আমিরের ইন্দোরের, রাশিদের রামপুর-সাসওয়ানের। ভেবে দেখুন, উত্তর ভারতে কত কাছাকাছি ওইসব শহর। কলকাতা যেন এই ক্ষণজন্মা, যুগোত্তীর্ণদের হাতে নীরব কোনও গান্ডা বেঁধে দিয়ে সম্পূর্ণ নিজের করে নিয়েছিল। কলকাতা পারে, বাংলা পারে। এনায়েত থেকে গিয়েছিলেন আমৃত্যু, রাশিদও তাই। এঁরা এক একটা সমুদ্র। এক একটা পাহাড়। বর্ষা ও গ্রীষ্মের দুই নদী।
ইউটিউবে কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তরুণ রাশিদের পুরোনো ইন্টারভিউ দেখছিলাম। সেখানে দুটো কথা শোনার পর আবার রিওয়াইন্ড করে শুনতে হল। আজকের দিনে এত অবিশ্বাস্য কথাগুলো। মামা গুলাম মুস্তাফা খান তাঁকে মুম্বই নিয়ে গিয়ে আট মাস শুধু সরগম করিয়েছিলেন। মন বসাতে না পেরে রাশিদ ফিরে গিয়েছিলেন বদাউনে। সেখানে দাদু নিসার হুসেন খান তাঁকে দু’তিন বছর ধরে শুধু ‘সা’ তুলিয়েছিলেন। শুধু ‘সা’।
তানসেনের ৩১তম উত্তরপুরুষ রাশিদের কণ্ঠবৈচিত্র্য, বিস্তার অনেককে মনে করিয়ে দিয়ে যেত আমির খানকে। মন্দ্র কণ্ঠস্বর শুনে খাড়া হয় প্রতি রোমকূপ। স্নিগ্ধ মগ্নতা ছড়িয়ে পড়ত চিন্তনে। যেন চার ভাবনার সঙ্গম– মেধা, বুদ্ধি, টেকনিক এবং টেমপারামেন্ট। রামপুর-সাসওয়ান ঘরানা তখন মিশে যেতে থাকে ইন্দোর ঘরানার সঙ্গে। আজ ভাবলে অবাক লাগে, দুই ওস্তাদের স্টাইলের বাইরেও কী অসম্ভব মিল। ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে কলকাতার পথে হারিয়ে গিয়েছিলেন আমির খান। বয়স তেমন হয়নি কিছু। ৬১। রাশিদের মতো তাঁরও অকালপ্রয়াণ। সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে গাড়ি দুর্ঘটনায়। সেতার ও সুরবাহারের রাজা, এনায়েত–বিলায়েতের পিতা বেঁচেছিলেন মাত্র ৪৩ বছর। এত অল্প বয়সেই এঁরা যুগোত্তীর্ণ সম্রাট।
ভারতের সবচেয়ে আলোচিত দুই শাস্ত্রীয় গায়কের তাঁর কুদরতি রংবেরঙ্গিতে তুলনা টেনেছিলেন কুমারপ্রসাদ, ‘বড়ে গুলাম আলি খানের স্টাইল ছিল বহির্মুখী, ক্রাউডপুলার। আমির খানের স্টাইল অন্তর্মুখী, দরবারি মেজাজ। আমির খান মনে করতেন, খেয়াল কম্পোজিশনে কবিতা খুব জরুরি।’ রাশিদকে এঁদেরই যোগ্য উত্তরসূরি ভাবে শাস্ত্রীয় জগৎ। পাকিস্তান থেকে গুলাম আলি যেমন শোকবার্তায় সেদিন বললেন, রাশিদ বিশ্বের এক নম্বর ক্ল্যাসিকাল গায়ক। ৯১ বছরের গায়িকা প্রভা আত্রেরও এক সুর, ওই আজকের ভারতে এক নম্বর ছিল। এবং রাশিদের গান শুনলে মনে হয়, তাঁর জীবনের প্রথম দিকটায় মিল আমিরের, আবার শেষদিকটা বড়ে গুলামের সঙ্গে।
আবার আমির বা রাশিদের ফিল্মি গানের মিল ধরতে বসলে কাছাকাছি এসে যান তাঁরা। আমির ছিলেন অনেক একবগ্গা। যৌবনে মধ্যপ্রদেশের রাজা চক্রধর সিংয়ের অধীনে কাজ করতেন। একবার রাজার প্রতিনিধি হয়ে গান গাইতে গিয়েছেন মির্জাপুরে সংগীত সম্মেলনে। সেখানে উদ্যোক্তারা বলেছিলেন ঠুংরি গাইতে। আমির বলে দেন, ঠুংরি গাওয়ার মন নেই। তাঁকে পনেরো মিনিটের মধ্যেই স্টেজ থেকে তুলে দেওয়া হয়। তবে শেষ দিকে ‘ফিল্মে গাওয়া নয়’, এমন ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা ছিল না আমিরের। ৭০ বছর আগে যা স্বাভাবিক ছিল। নৌশাদের সুরে বৈজু বাওরা এবং শাবাব, বসন্ত দেশাইয়ের সুরে ঝনক ঝনক পায়েল বাজে, গুঞ্জ উঠি সেহনাইয়ের মতো সুপারহিট ছবিতে গেয়েছেন স্বচ্ছন্দে। ক্ষুধিত পাষাণ ছবিতে আলি আকবরের সুরে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ডুয়েটও গেয়েছেন-ক্যায়সে কাটে রজনি। রাশিদের যেমন আও যো তুমনে যেমন কাল্ট গান হয়ে উঠেছে, তেমনই আমিরের বৈজু বাওরার মেঘ রাগে ঘনন ঘনন ৭২ বছর আগে কাল্ট গান হয়ে উঠেছিল।