নয়াদিল্লি: পার্লামেন্ট নাকি হিলকার্ট রোড? সোমবার ঐতিহাসিক সংসদ ভবনকে দেখে চেনার উপায় নেই। বাদল অধিবেশন শেষ হয়েছে দশদিন হল, এখন ছুটির মরশুম অথচ যেই দিকে চোখ যায় সেদিকেই থইথই করছে ভিড়, অধিকাংশ বাংলা ভাষাভাষীর মানুষ, যারা এসেছেন উত্তরবঙ্গ থেকে। সোমবার সংসদ ভবন দখল করল এক জোড়া উত্তরবঙ্গ। একপক্ষের মানুষ এসেছেন আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং থেকে; রাজ্যসভায় নব্যমনোনীত তৃণমূল সাংসদ প্রকাশ চিক বরাইক এর শপথগ্রহণে অংশ নিতে। অন্য পক্ষটি এসেছে কোচবিহার, অসম, ত্রিপুরার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে, বিজেপি সাংসদ নগেন্দ্র নাথ রায় ওরফে অনন্ত মহারাজের শপথগ্রহণে সাক্ষী থাকতে। উত্তরবঙ্গের একজোড়া মিলিত উচ্ছ্বাসে সোমবার কার্যত ভেসে গেল সংসদ।
পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী সোমবার সংসদে রাজ্যসভা সদস্য রূপে আনুষ্ঠানিক শপথ নিলেন পশ্চিমবঙ্গ এবং গুজরাটের মোট ৯জন সাংসদ। বাংলার শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে এ দিন শপথ নিলেন ৫ জন, যাঁদের মধ্যে তৃতীয়বার উচ্চ কক্ষের সদস্য রূপে শপথ নিলেন দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন, সুখেন্দুশেখর রায় এবং দোলা সেন। নবাগতদের মধ্যে শপথ নিলেন অধ্যাপক সামিরুল ইসলাম এবং উত্তরবঙ্গের আদিবাসী সমাজের বিশিষ্ট প্রতিনিধি প্রকাশ চিক বরাইক৷ দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে বঙ্গীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের কথা মাথায় তৃণমূল সাংসদ রা ধুতি, পঞ্জাবি এবং শাড়ি পরে শপথ নিয়েছেন রাজ্যসভায়।
এদিন উত্তরবঙ্গ থেকে বিজেপি শিবিরে প্রতিনিধি রূপে সোমবার শপথ নিলেন কোচবিহারে রাজবংশী সমাজের প্রভাবশালী নেতা অনন্ত মহারাজ। এর পাশাপাশি রাজ্যসভায় এদিন শপথ নেন বিদেশ মন্ত্রী ড. সুব্রহ্মনিয়ম জয়শঙ্কর সহ গুজরাটের দুই বিজেপি নেতা বাবুভাই দেশাই ও কেশরীদেব সিং জালা। শপথবাক্য পাঠের মধ্যেও লক্ষ্য করা গেছে বৈচিত্র্য। এদিন হিন্দিতে শপথবাক্য পাঠ করেন ৩ জন – গুজরাটের দুই বিজেপি সাংসদ সহ কোচবিহারের অনন্ত মহারাজ। ডেরেক, দোলা, সুখেন্দু, সামিরুলরা বাংলায় শপথ নেন। বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং আলিপুরদুয়ার প্রতিনিধি হিসেবে প্রকাশ চিক বরাইক শপথ নেন ইংরেজি ভাষায়৷ প্রশ্ন উঠেছে, উত্তরবঙ্গ থেকে রাজ্যসভায় আগত দুই সাংসদ বিজেপির অনন্ত মহারাজ এবং তৃণমূল কংগ্রেসের প্রকাশ চিক বরাইক বাংলা বা কোনও আঞ্চলিক ভাষার পরিবর্তে কেন হিন্দি ও ইংরেজিতে শপথগ্রহণ করলেন?
প্রসঙ্গত, উত্তরবঙ্গের এই দুই সাংসদকে নিয়েও আজ যথেষ্ট উৎসাহ চোখে পড়ে সংসদে। তাঁদের পোশাক-পরিচ্ছদও ছিল যথেষ্ট নজরকাড়া৷ কোচবিহারের রাজবংশী সমাজের প্রভাবশালী প্রতিনিধি নগেন্দ্রনাথ রায় (অনন্ত মহারাজ) এদিন রীতিমতো রাজবেশে হাজির হয়েছিলেন রাজ্যসভায়। মাথায় পাগড়ি, উষ্ণীষ, গলায় গেরুয়া পট্টবস্ত্র পরিহিত অনন্ত মহারাজ নজর কেড়েছেন সকলের। রাজ্যসভা নির্বাচনে বাংলা থেকে একমাত্র আসনে অনন্ত মহারাজকে প্রার্থী করেছে বিজেপি। অনন্ত প্রার্থী হওয়ার পর থেকে ‘বাংলা ভাগের চক্রান্ত’ ইস্যুতে ভালো শান দিচ্ছে বিরোধীরা। অন্যদিকে রাজবংশী ভাবাবেগ কাজে লাগিয়ে ২০২৪-র লোকসভা নির্বাচনে ফায়দা তুলতে ‘মাস্টারস্ট্রোক’ দিয়েছে বিজেপি। এদিন অনন্ত মহারাজের শপথ গ্রহণের সাক্ষী থাকতে সংসদে উপস্থিত হয়েছেন উত্তরবঙ্গের অসংখ্য মানুষ। যদিও তাঁকে রাজ্যসভায় জায়গা করে দেওয়ার নেপথ্যে যার অন্যতম অবদান, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তথা কোচবিহার সাংসদ নিশীথ প্রামাণিককে কিন্তু এদিন দেখা যায়নি রাজ্যসভার ট্রেজারী বেঞ্চে।
অনন্ত মহারাজের পাশেই সংসদে উত্তরবঙ্গের আরেক প্রতিনিধি, আলিপুরদুয়ারের রাজ্যসভা তৃণমূল সাংসদ প্রকাশ চিক বরাইকের পোশাক পরিচ্ছদও ছিল আকর্ষণীয়। মাথায় হলুদ ফেট্টি, গলায় উত্তরবঙ্গের কাঁথা স্টিচের উত্তরীয় পরে সভার আসতে দেখা যায় প্রকাশকে। বলে রাখা প্রয়োজন আলিপুরদুয়ারের আদিবাসী চিক বরাইক সমাজের প্রতিনিধি, অতীতে চা বাগানের একজন সামান্য শ্রমিক প্রকাশ চিক বরাইক ২০০৪ সালে শিলিগুড়ির সূর্য সেন কলেজ থেকে স্নাতক হন। ওয়ার্কার্স হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছেন কালচিনির হিন্দি হাইস্কুল থেকে। ২০০৪ সালে স্নাতক হয়েই চা বাগানের কাজে যোগ দেন। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে কুমারগ্রাম এনকেএস গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য হিসেবে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। জনপ্রতিনিধি হিসেবে এটাই তাঁর একমাত্র অভিজ্ঞতা। তবে দায়িত্ব পেয়েই কাজ করে দেখিয়েছেন প্রকাশ চিক বরাইক। বিধানসভা নির্বাচনের ব্যর্থতা মুছে দিয়ে গত বছর পুরসভা ভোটে ফালাকাটা, আলিপুরদুয়ার বিপুলভাবে দখল করে তৃণমূল। এবারের পঞ্চায়েত ভোটেও তাঁর নেতৃত্বে বিজেপিকে আটকে জেলায় দুর্দান্ত ফল করেছে তৃণমূল। রাজনৈতিক মহলের ধারণা উত্তরবঙ্গে হারানো জমি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে চা বলয়কে টার্গেট করেছেন তৃণমূল দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর সেই কারণেই চা শ্রমিক তথা আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রকাশ চিক বরাইককে রাজ্যসভায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তৃণমূল। সোমবার শপথগ্রহণের পর দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দলের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কেও কৃতজ্ঞতা জানাতে ভোলেননি প্রকাশ চিক বরাইক। এদিন তাঁর শপথগ্রহণে অংশ নিতে আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি এবং দার্জিলিং থেকে অসংখ্য মানুষ সংসদে হাজির হয়েছিলেন।