প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লিঃ এমন দৃশ্য কার্যত বিরল। সংসদ ভবনের ‘মকর দ্বার’ প্রান্তে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রীয় শাসক দলের প্রতি চোস্ত ইংরেজিতে একের পর এক তোপ দাগছেন প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র৷ একটু আগে খুইয়েছেন সাংসদ পদ, ‘ক্যাশ ফর কোয়েশ্চেন’ বিতর্কে সংসদে তাঁকে বক্তব্য রাখার সুযোগ দেন নি অধ্যক্ষ ওম বিড়লা৷ সাসপেনশনের প্রতিবাদে ওয়াক আউট করেছে তামাম বিরোধী শিবির। গান্ধিমূর্তির পাদদেশে ধরনায় বসার ঠিক আগে মহুয়া মৈত্র সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলেন যখন তাঁকে ঘিরে তখন নক্ষত্ররাজির ভিড়। মহুয়ার ঠিক পিছনেই সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে সনিয়া গান্ধি, ডানদিকে রাহুল, বাঁ দিকে দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌগত রায়, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, একটু পাশে আরএসপি সাংসদ এনকে প্রেমচন্দ্রণ, সিপিএম সাংসদ পিআর নটরাজন, বসপা সাংসদ দানিশ আলি, ন্যাশনাল কনফারেন্সের ফারুক আবদুল্লা সহ আরও অনেকে৷
প্রত্যেকে মুগ্ধচোখে তাকিয়ে মহুয়ার দিকে। সাদা লালপাড় শাড়ি, লাল ব্লাউজ পরিহিত মহুয়া নিজে তখন বিদ্রোহী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার কয়েক লাইন আওড়াচ্ছিলেন। মহুয়ার ভাষণ শেষ হতেই উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন সনিয়া৷ হাততালি দিয়ে বলেন, ‘প্রাউড অফ ইউ মহুয়া’। অন্যরাও গলা মেলান তাতে৷ রাহুল গান্ধি এসে হ্যান্ডশেক করেন। এরপর একজোটে তাঁরা এগিয়ে গেছেন গান্ধিমূর্তির দিকে প্রতীকী ধরনা দিতে। জনৈক তৃণমূল সাংসদের উক্তি, ‘সত্যি এমন দৃশ্য, এমন স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন আগে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।’
তৃণমূল কংগ্রেসের পাশাপাশি এই ইস্যুতে প্রথমদিন থেকেই মহুয়ার পাশে দাঁড়িয়েছে কংগ্রেস৷ লোকসভার দলনেতা অধীর চৌধুরী বেশ কয়েকটি চিঠি লিখেছিলেন লোকসভার অধ্যক্ষ ওম বিড়লাকে৷ চিঠি লেখেন বসপা সাংসদ দানিশ আলিও। শুক্রবার যখন দুপুর ১২টা নাগাদ লোকসভায় এথিক্স কমিটির রিপোর্ট জমা পড়ে তখনও অধীর সেই ৪৯৫ পাতার রিপোর্ট ভালো করে পড়ে দেখার জন্য লোকসভা অধ্যক্ষকে চিঠি লিখে কয়েকদিন বাড়তি সময় চান৷ যদিও স্পিকার তাকে সেই সময় দেননি৷ মধ্যাহ্ন ভোজের বিরতির পরে এথিক্স কমিটির সুপারিশ মেনে সরকারপক্ষের ইচ্ছানুযায়ী মহুয়া মৈত্রকে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনও সুযোগ না দিয়েই ধ্বনি ভোটের মাধ্যমে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন লোকসভা স্পিকার ওম বিড়লা৷
এর পরেই মহুয়া মৈত্রর সমর্থনে এগিয়ে আসেন বিরোধী শিবিরের তাবড় নেতা-নেত্রীরা। স্থির হয় সংসদ চত্বরে গান্ধিমূর্তির সামনে প্রতিবাদ বিক্ষোভ দেখাবেন বিরোধী শিবিরের সাংসদরা৷ লোকসভায় তৃণমূলের নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় জানান তিনি তাদের দলের সব সাংসদদের নিয়ে গান্ধি মূর্তির সামনে যাচ্ছেন৷ সেই মত কংগ্রেস সংসদীয় দলের চেয়ারপার্সন সনিয়া নিজেই বিরোধী শিবিরের সব সাংসদকে সঙ্গে নিয়ে গান্ধি মূর্তির দিকে পায়ে হেঁটে রওয়ানা দেন৷ তাঁর সঙ্গে পা মেলান রাহুল গান্ধি, অধীর চৌধুরী, বর্ষীয়ান তৃণমূল সাংসদ ও লোকসভায় দলের নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, অপরূপা পোদ্দার, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল মণ্ডল, অসিত মাল প্রমুখ৷ ছিলেন আরএসপি সাংসদ এন কে প্রেমচন্দ্রন সহ অন্যান্য দলের নেতারাও৷ এই বিরোধী সাংসদদের সঙ্গে যোগ দেন তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রও৷ সংসদের মকর দ্বারের সামনে সংবাদ মাধ্যমের সামনে বক্তব্য রাখেন মহুয়া৷ তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ খারিজ করেন মহুয়া৷ প্রায় মিনিট সাতে ক ধরে নিজের বক্তব্য রাখেন মহুয়া৷ সেই সময়ে তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন সনিয়া, রাহুল গান্ধি, সুদীপ বন্দ্যেপাধ্যায়, ফারুখ আবদুল্লা, দানিশ আলি, সুপ্রিয়া সুলে সহ তাবড় বিরোধী নেতা-নেত্রীরা৷ মহুয়ার বক্তব্য শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সনিয়া গান্ধি তাঁকে বলেন, ‘প্রাউড অফ ইউ।’ অন্যান্য সাংসদরা সবাই হাততালি দিয়ে ওঠেন৷ স্লোগান ওঠে, ‘মহুয়া তুম আগে বড়ো, হাম তুমহারে সাথ হ্যায়’। কয়েকজন পথচলতি বিজেপি সাংসদ অবশ্য ‘মহুয়া মৈত্র শেম শেম’ স্লোগান দেওয়ার চেষ্টা করলেও, বিরোধীদের প্রবল হইহট্টগোলে তা ঢাকা পড়ে যায়। এর পরে শুরু হয় গান্ধী মূর্তির সামনে প্রতীকি ধরনা৷ সামিল হন সনিয়া গান্ধিও৷
তাত্পর্যপূর্ণ হল, রাহুল গান্ধির লোকসভার সাংসদ পদ খারিজের সিদ্ধান্তকে যেমন আইনি চৌকাঠে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছিল ঠিক সেই ভাবেই মহুয়া মৈত্রর বহিষ্কারের সিদ্ধান্তকেও আইনি চৌকাঠে চ্যালেঞ্জ জানানোর সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখছেন বিরোধী শিবিরের প্রথম সারির নেতারা৷ সংসদীয় সূত্রের দাবি, এই মর্মে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখা যেতে পারে কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেস শিবিরের আইনজীবী সাংসদদের৷ আইনি বিশেষজ্ঞরা একমত হলেই দেশের শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে ইন্ডিয়া জোট৷ সূত্রের দাবি, এই মর্মে আলাদা মামলা করতে পারেন সদ্য লোকসভা থেকে বহিষ্কৃত হওয়া তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র নিজেও৷