রাম মন্দির উদ্বোধনের খবর সংগ্রহে অযোধ্যায় গিয়েছিলাম। দেশের নানা প্রান্ত থেকে কয়েকশো সাংবাদিক সেখানে হাজির হয়েছিলেন। দুয়ারে লোকসভা ভোট। মিডিয়া সেন্টারে বসে সাংবাদিকদের আড্ডায় বিভিন্ন রাজ্যের ঘরোয়া রাজনীতির প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে আসছিল। আলোচনা গড়াল লোকসভা ভোটে রাম মন্দিরের প্রভাব নিয়ে।
রামরথ থেকে রাম মন্দির-বিজেপির এই বিজয় সরণির প্রভাব একটি পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট। ৪৪ বছর বয়সি দলটি জন্মের পাঁচ বছর পর প্রথমবার লোকসভা নির্বাচনে (১৯৮৪) অংশ নিয়ে খাতা খুলেছিল দুটি মাত্র আসন দিয়ে। তারপর রাজনীতির রামপথ ধরে তারা পৌঁছে গিয়েছে, ৩০৩-এ। ২০২৪ নিয়ে পদ্ম শিবির আওয়াজ তুলেছে, ‘ইসবার, চারশো পার।’
দেশবাসী বিজেপির মনোবাঞ্ছা পূরণ করবেন কি না, সময়ই বলবে। তবে মিডিয়ার একাংশ যে সেই স্বপ্নপূরণে পদ্ম শিবিরের পাশে আছে তা টের পেলাম বিগ স্ক্রিনে নরেন্দ্র মোদির ছবি ভেসে উঠতে। মিডিয়া সেন্টার কেঁপে উঠল জয় শ্রীরাম ধ্বনিতে। গোটা উদ্বোধন পর্বজুড়েই তা চলল। জয়ধ্বনিতে রাম এবং মোদিতে ফারাক ছিল না। বোঝাই গেল সেই সাংবাদিক-বন্ধুদের চোখে মোদি এখন রামের অবতার।
কথায় কথায়, এক সাংবাদিক ২২ জানুয়ারিকে মন্দির উদ্বোধনের জন্য বেছে নেওয়ার শাস্ত্রীয় বিধি শোনাচ্ছিলেন। বললাম, শাস্ত্র মতে, দিনটি ২৬ জানুয়ারি অর্থাৎ প্রজাতন্ত্র দিবস হলে কী হত? এরপর কথা আর এগোল না।প্রশ্নটা রাম মন্দিরের শিলান্যাসের সময়ও কড়া নেড়েছিল। ২০২০-র ৫ অগাস্ট প্রধানমন্ত্রীই মন্দিরের শিলান্যাস করেছিলেন। দেশ তখন করোনা লকডাউনে গৃহবন্দি। অগাস্ট স্বাধীনতার মাস। ১৫ অগাস্ট স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রী লালকেল্লা থেকে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। ৯ অগাস্ট দেশ ‘অগাস্ট ক্রান্তি দিবস’ পালন করে।
রাম মন্দির শিলান্যাস ছাড়াও মোদি সরকার সেই অগাস্ট মাসে আরও কিছু গুরুত্বপূণ পদক্ষেপ করেছে। ২০১৯-এর ৫ অগাস্ট-ই সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিলের প্রস্তাব সংসদে পেশ করা হয়েছিল। তার আগের বছর ১ অগাস্ট তিন তালাক বিরোধী আইন কার্যকর করে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালুর পক্ষে কয়েক কদম এগিয়ে যায়।
২০২১-এর ৫ অগাস্ট ৪১ বছরের খরা কাটিয়ে টোকিও অলিম্পিকে হকিতে ব্রোঞ্জ পদক লাভ করে ভারত। সেদিন উত্তরপ্রদেশে জনসভার মঞ্চ থেকে হকি দলকে অভিনন্দন জানাতে গিয়ে মোদি শুনিয়েছিলেন আরও কী কী কারণে ৫ অগাস্ট ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বলেছিলেন, ‘মনে হচ্ছে ভারতের বিজয় যাত্রা শুরু হয়ে গিয়েছে। তাতে ৫ অগাস্ট বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই তারিখটি ইতিহাসে গুরুত্ব বহন করবে।’
গুরুত্ব বোঝাতে বলেছিলেন, ‘দু’বছর আগে ৫ অগাস্ট ভারতের স্বপ্ন আরও শক্তিশালী হয়েছিল সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ বিলোপের মাধ্যমে, যা জম্মু ও কাশ্মীরের প্রত্যেক নাগরিককে সব সুবিধার পূর্ণ অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করে।’ রাম মন্দিরের প্রসঙ্গ জুড়ে বলেছিলেন, গত বছর ৫ অগাস্ট ছিল বহু শতাব্দী অপেক্ষা শেষে কোটি কোটি ভারতীয়ের প্রত্যাশার রাম মন্দির নির্মাণের দিকে প্রথম পদক্ষেপ।’
কাশ্মীর, রাম মন্দিরের সঙ্গে বিজেপির রসায়ন গোটা দেশ জানে। ১৯৯৬-এ ১৩ দিনের মাথায় দেশের প্রথম বিজেপি সরকারের পতনের দিন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী সংসদে বিতর্কের জবাবি ভাষণে এই সব কর্মসূচির উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘ইয়ে বাত সহি হ্যায়, ছুপানে কা কোয়ি বাত েনহি হ্যায়। ইয়ে হমারা ইস সময় কে কারিক্রম মে েনহি হ্যায়। ইসলিয়ে েনহি হ্যায়, কী হমারা পাস বহুমত্ নেহি হ্যায়।’
আদবানি, বাজপেয়ীদের সেই অসম্পূর্ণ ইচ্ছা বা কর্মসূচির জোরে মোদি আজ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকারে আসীন। অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল এবং অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বা ইউনিফর্ম সিভিল কোড চালু সেই কর্মসূচির অন্যতম। প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতার মাসে শিলান্যাস করা রাম মন্দিরের উদ্বোধন করলেন সংবিধান প্রণয়নের মাসে, প্রজাতন্ত্র দিবসের চারদিন আগে।
সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারত ‘সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র।’ এই ঘোষণার খসড়া গণপরিষদে পেশ করেছিলেন জওহরলাল নেহরু, যা গৃহীত হয়েছিল ১৯৪৭-এর ২২ জানুয়ারি। ভারত রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষার আদর্শ রক্ষার অঙ্গীকারের কথা জানিয়ে তাই সংস্কার হওয়া সোমনাথ মন্দির উদ্বোধনে না যেতে রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদকে চিঠি লিখে মানা করেছিলেন প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরু। রাজেন্দ্র প্রসাদ শোনেননি।
সেই ভারতে রাম মন্দির নিয়ে মোদির উদ্দেশে এমন কোনও উচ্চকণ্ঠে আপত্তি কিন্তু শোনা গেল না। নেহরুর দল ২২ জানুয়ারির অনুষ্ঠান বয়কট করে সেটি বিজেপি-আরএসএসের কর্মসূচি হয়ে ওঠায়। প্রধানমন্ত্রী কেন বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়ের উপাসনাস্থলের শিলান্যাস, উদ্বোধন করবেন, সে প্রশ্ন মল্লিকার্জুন খাড়গে, েসানিয়া, রাহুলরা তোলেননি।
কথা হল, নরেন্দ্র মোিদ, অমিত শা’রা জানুয়ারি, অগাস্ট মাসকে বেছে নিয়েছেন কেন? মোিদ সরকারের সংখ্যালঘু বিষয়কমন্ত্রক ২০১৯ থেকে ১ অগাস্টকে নারীর ক্ষমতায়ন দিবস হিসাবে পালন করে। তৎকালীন মন্ত্রী মুক্তার আব্বাস নকভি বলেছিলেন, ‘তিন তালাক থেকে মুক্তি মুসলিম মা-বোনেদের জন্য এক বিরাট স্বাধীনতা প্রাপ্তি।’
অগাস্ট শুধু স্বাধীনতা প্রাপ্তির মাস নয়, পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তির দুশো বছরের লড়াইয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় গািন্ধর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল এই মাসেই। মোিদ-অমিত শা-মোহন ভাগবতদের পরিকল্পনা থেকে স্পষ্ট, জানুয়ারি, অগাস্ট মাস নিয়ে স্বাধীনতা, প্রজাতন্ত্রের ভিন্ন আখ্যান তৈরি করতে চাইছে গেরুয়া শিবির।
বিজেপি বিরোধীরা তো বটেই, প্রথম সারির ইতিহাসবিদেরাও স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দুত্ববাদীদের অবদান স্বীকার করেননি। বিজেপি ও সংঘ পরিবার তাই সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের বিলোপ, তিন তালাক প্রথা রদ, অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণকে দেশবাসীর নবস্বাধীনতা প্রাপ্তি হিসাবে তুলে ধরতে ব্যস্ত যা তাদের লড়াই-সংগ্রাম-আন্দোলনের ফসল। তাই অগাস্ট মাসকেই দলের বিশেষ কর্মসূচিগুলি রূপায়ণের জন্য বেছে নিয়েছে তারা।
গেরুয়াবাদীদের দৃষ্টিতে দাসত্বের সময়কালে ব্রিটিশের দুশো বছরের শাসনের তুলনায় সুলতানি ও মোগল সাম্রাজ্য বেশি গুরুত্ব পেয়ে আসছে। মোগল সম্রাট বাবরের সময় অযোধ্যায় রাম মন্দির ভেঙে বাবরি মসজিদ তৈরির অভিযোগ ছিল। সেই মসজিদের জায়গায় মন্দির নির্মাণ প্রধানমন্ত্রী দাসত্বের মানসিকতা থেকে মুক্তি প্রাপ্তি বলে উল্লেখ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সূচনা হল নতুন যুগের। রাম মন্দির উন্নত ভারত গড়ার সংকল্প স্থির করে দিয়েছে।’ দাসত্বের মানসিকতা থেকে মুক্তি এবং নতুন ভারত গড়ার কথা বলে প্রধানমন্ত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন, রাম মন্দিরের উদ্বোধনকে তিনি দেশবাসীর নয়া স্বাধীনতা প্রাপ্তি, পরাধীনতা মুক্তি হিসাবে তুলে ধরতে সচেষ্ট।
শুধু স্বাধীনতা, সংবিধানের মাসে নাম তোলাই নয়, হিন্দুত্ববাদী শিবিরের নিশানায় কংগ্রেসও। ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ের সুবাদে ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে কংগ্রেস যে শিকড় বিস্তার করতে পেরেছিল, তা উপড়ে ফেলতে হিন্দুত্ববাদীরা সুলতানি ও মোগল আমলের দাসত্বকে হাতিয়ার করেছে। অগাস্টের সঙ্গে নানাভাবে জড়িয়ে লম্বা সময় দেশ শাসন করা কংগ্রেসের দীর্ঘ ইতিহাস, ঐতিহ্য। সেই ইতিহাসে অনেক অতিরঞ্জন, বিকৃতি আছে, সন্দেহ নেই। স্বাধীনতা মানে কংগ্রেস, পরিকল্পিতভাবেই জনমনে এমন ধারণা বদ্ধমূল করে তোলা হয়েছে। আসলে সব ইতিহাসেরই দুটি ধারা থাকে। একটি পত্রপত্রিকা, পাঠ্যপুস্তক, গবেষণাপত্র ইত্যাদি। দ্বিতীয়টি জনবিশ্বাস, ধারণা।
বিজেপি দাসত্ব, পরাধীনতা, স্বাধীনতার নয়া ধারণা দিয়ে আমজনতার মন-মস্তিষ্কে উপনিবেশ গড়তে তৎপর। তাই স্বাধীনতা, সংবিধানের মাসের সঙ্গে জুড়তে চায় দলের সাফল্য। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইতিহাসের ছাত্র শা তো দম্ভভরে বলেই রেখেছেন, ‘ইতিহাস নতুন করে লেখা হলে কে আমাদের রুখবে?’
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: শাকিব খান(Shakib Khan)। বাংলাদেশের(Bangladesh) সিনেমা জগতের বড় নাম শাকিব খান। তাঁর…
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং আছে দুবাইয়ে (Dubai)। এবার বিশ্বের সবচেয়ে বড়…
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: লোকসভা ভোটের (Lok Sabha Election 2024) দু’দফা মিটেছে। বাংলার ৪২ আসনের…
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ সোমবার সুপ্রিম কোর্টে তিন মাস মুলতবি হয়ে গেল সন্দেশখালি মামলার শুনানি।…
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: পশ্চিমবঙ্গের মতো পরিস্থিতি কেরলেও (Kerala Heatwave)। গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত অবস্থা। আগামী…
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ সংরক্ষণ কোটা নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শা’র একটি ভিডিয়ো ভাইরাল হয়েছে…
This website uses cookies.