মিঠুন ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি: মধ্যরাতে বাড়ির টিনের দরজায় টোকা। সাংকেতিক ভাষায় ভেসে আসে, ‘অমুকের একটা ফুল চাই।’ কে চাইল তা জানাটা জরুরি নয়, তাই মুখ না দেখেই বেড়ার ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে বোতলখানা বের করে দেন গৃহকর্তা। বিনিময়ে বাড়তি পয়সা বুঝে নিয়ে ল্যাঠা চুকে যায় তাঁর। কিংবা ধরুন, পাড়ার গলির ভেতর টিমটিমে আলো জ্বলা কোনও মুদি দোকানে গিয়ে আপনি বললেন, ‘দাদা, একটা হাফ হবে নাকি?’ দোকানদার যদি বুঝে যান, আপনাকে দিয়ে দিলে বিপদ নেই, তবে মুহূর্তে আপনার হাত ভরে উঠতে পারে নির্দিষ্ট ওই ব্র্যান্ডের মদের বোতলে। যা চাইবেন, তাই পাবেন। শুধু গ্যাঁট থেকে একটু বাড়তি কড়ি খসবে এই আর কী!
শিলিগুড়ি(Siliguri) থানা এলাকার টিকিয়াপাড়া, ফুলেশ্বরী, মাটিগাড়া ও প্রধাননগর থানার বালাসন কলোনি, শালবাড়ি, দেবীডাঙ্গার মতো এলাকা তো বটেই, রাজগঞ্জ ও ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ির পাড়ায় পাড়ায় চলছে এমন মদের ঠেক। কিছু জায়গায় তো আবার বাড়ির ভেতর বসে খাওয়ার বন্দোবস্তও আছে বেশ। শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেট এলাকাতেই এমন অবৈধ মদের ঠেকের সংখ্যা হাজারেরও বেশি। অধিকাংশ জায়গাতেই পুলিশকে মাসোহারা দিয়ে এমন অবৈধ ঠেক চলছে বলে সরাসরি অভিযোগ করেছেন আবগারি দপ্তরের জলপাইগুড়ি জেলার অতিরিক্ত সুপারিন্টেন্ডেন্ট সুপ্রকাশ মণ্ডল। তিনি উত্তরবঙ্গ সংবাদকে বলছেন, ‘যারা অবৈধ ঠেক চালাচ্ছে তাদের জিজ্ঞাসা করলেই বলে দেবে পয়সা কাকে দিচ্ছে। পুলিশ এক মাস পয়সা না পেলেই অভিযান চালায়।’
পুলিশ আবার পালটা দায় চাপাচ্ছে আবগারি দপ্তরের ওপর। শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেটের ডিসিপি (হেডকোয়ার্টার) তন্ময় সরকার খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন। তবে, পুলিশের এক কর্তার যুক্তি, ‘শুধু পুলিশকে দোষ দিলে হবে না। এরকম ঘটতে থাকলে আবগারিরও কিছু ভূমিকা থাকে।’ জলপাইগুড়ির ডিসিপি (হেডকোয়ার্টার) শেরপ দোরজি লেপচার বক্তব্য, ‘এরকম খোঁজ থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এতদিন সাধারণ মানুষ পুলিশের বিরুদ্ধে মদের ঠেক থেকে টাকা তোলার অভিযোগ করলেও এবার খোদ আবগারি দপ্তর পুলিশের বিরুদ্ধে মুখ খোলায় বিষয়টি নিয়ে হইচই শুরু হয়েছে। মাসোহারার বিনিময়ে এসব কাজে পুলিশের মদতের অভিযোগ স্বীকার করে নিয়েছে বহু অবৈধ মদের কারবারি। ভোরের আলো থানার অন্তর্গত আদর্শপল্লি এলাকার এক কারবারির কথায়, ‘মাসে দুই হাজার টাকা করে দিতে হয় পুলিশকে। নইলে কারবার চালাতে দেওয়া হবে না বলে হুমকি দেওয়া হয়।’ বেলাকোবার বাসিন্দা অম্লান মজুমদারের অভিযোগ, ‘পুলিশের মদতেই বাড়বাড়ন্ত মাদক কারবারের। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য ওরাই দায়ী।’
শিলিগুড়ি শহর ছাড়িয়ে যত শহরতলির দিকে যাওয়া যায়, ততই বেশি করে চোখে পড়ে অবৈধ মদের ঠেক। ইস্টার্ন বাইপাস, বাড়িভাসা, শান্তিনগর, ঠাকুরনগরে রমরমা কারবার চললেও পুলিশ ও আবগারি দপ্তর ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে। মাঝেমধ্যে দু-একটি জায়গায় লোকদেখানো অভিযান হয় বটে, তাতে লাভের লাভ হয় না কিছুই। মাসখানেক আগে সুকান্তনগরে একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। বাড়ির ভেতরেই চলছিল পানশালা। সবথেকে বেশি অবৈধ মদের কারবার চলে নিউ জলপাইগুড়ি ও ভক্তিনগর থানা এলাকায়। ভক্তিনগরের রিতা পাল বলছেন, ‘হোলি-দেওয়ালি কিংবা ছুটির দিন, কোথাও মদ না পাওয়া গেলেও নিউ জলপাইগুড়ি এলাকায় পাওয়া যাবেই।’ এসব খুল্লমখুল্লা হলেও কোনও ব্যবস্থাই নেয় না পুলিশ ও আবগারি দপ্তর, কটাক্ষ তাঁর।
যদিও এসবে আবগারি দপ্তরের কোনও ভূমিকা নেই বলে সাফ জানিয়েছেন সুপ্রকাশ মণ্ডল। আবগারি কর্তার দাবি, ‘অবৈধ মদের ঠেক বন্ধে আমাদের ভূমিকা থাকলে তো আবগারি দপ্তর পয়সা তুলতে যেত। সেটা কখনও শুনেছেন?’