শুভঙ্কর চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি: রামকৃষ্ণ মিশনে (Ramakrishna Mission) হামলার মূল অভিযুক্ত প্রদীপ রায় পলাতক। সূত্রের খবর, তিনি কোচবিহারে গা-ঢাকা দিয়েছেন। এখনও তাঁর টিকিটিও ছুঁতে পারেনি পুলিশ। তবে মিশনের জমি দখলের চক্রান্তে প্রদীপ কি আসল অপরাধী না কি এর পেছনে অন্য মাস্টারমাইন্ড রয়েছে? কীভাবে মিশনে হামলার ছক হয়েছিল? পুলিশ এইসব প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারছে না। তবে উত্তরবঙ্গ সংবাদের অন্তর্তদন্তে উঠে এসেছে মিশনে হামলার চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য।
চারদিন পর বৃহস্পতিবার সকালে সেবক হাউসে (Sewak House) ঢোকেন রামকৃষ্ণ মিশনের কর্মী ও সন্ন্যাসীরা। মিশনের বেলুড় মঠের আধিকারিক ও আইনজীবীরাও এদিন শিলিগুড়িতে (Siliguri) এসেছিলেন। পুলিশের একাধিক বড় কর্তার সঙ্গে তাঁরা বৈঠকও করেন। পুলিশ সূত্রে জানানো হয়েছে, আপাতত কিছুদিন একজন এসআই-এর নেতৃত্বে ছয়জন সশস্ত্র কনস্টেবল সেবক হাউসের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবেন। ঘটনার পর কোনও বেসরকারি নিরাপত্তা এজেন্সি সেবক হাউসের দায়িত্ব নিতে চাইছে না বলেই খবর। মিশন সূত্রের খবর, সেবক হাউস থেকে একটি কম্পিউটার সেট চুরি হয়েছে। সিসি ক্যামেরার প্রযুক্তি এমনভাবে নষ্ট করা হয়েছে যা থেকে পুলিশের অনুমান, হামলায় প্রযুক্তিগত দিক থেকে দক্ষ কেউ উপস্থিত ছিল।
এসবের মাঝে বৃহস্পতিবার রাজ্যপালের তরফে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়, রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও স্বামী বিবেকানন্দের মতো মহান ব্যক্তিত্বদের নাম জড়িত। কেউ যদি জেনেবুঝে বা অজান্তে ওই সংগঠনকে অসম্মান করেন, তাহলে মনে রাখতে হবে তাঁরা রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ সহ মহান ব্যক্তিত্বদের অসম্মান করছেন। এই ঘটনা মানুষের ভাবাবেগে আঘাত করবে। বিবৃতিতে শ্রীকৃষ্ণের সেই অমোঘ বাণী, ‘বিনাশকালে বুদ্ধিনাশ’ উল্লেখ করেছেন রাজ্যপাল।
কীভাবে হয়েছিল সেবক হাউসের অপারেশন? সূত্রের খবর, প্রদীপ ও তাঁর মা বিদ্যেশ্বরী রায়কে শিখণ্ডী করে মাস চারেক আগে সেবক হাউস দখলের ঘুঁটি সাজানো হয়েছিল দিল্লিতে। কলকাতার জমি মাফিয়া হালদারের বাবা দিল্লির প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। অনেক নেতা, মন্ত্রীদের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা। শিলিগুড়ির দুই অবাঙালি ব্যবসায়ী সহ কয়েকজন দিল্লির বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। হামলার তিনদিন আগে থেকে সেবক হাউসের আশপাশে রেইকি করা হয়। সেবক হাউসে নিয়মিত নজরদারি ও প্রদীপের সঙ্গে যোগাযোগের মধ্যস্থতাকারী হিসাবে প্রদীপের আত্মীয় এক তরুণকে বাছা হয়, যার বাড়ি সেবক হাউস লাগোয়া এলাকায়।
উত্তরকন্যার উলটো দিকে নতুন ডেরা খুলেছে হালদার। বিপর্যয়ের সময় যেভাবে কন্ট্রোল রুম খুলে কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করা হয়, সেভাবেই ওই ডেরা থেকে মিশনে হামলার দিন গুন্ডাদের নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছিল। অভিযানের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল বেশ কয়েকটি অটো এবং বাইক। হামলার দিন রাতে হালদারের ডেরায় ভোজের আয়োজনও করা হয়েছিল। সেখানে এক আইনজীবীও উপস্থিত ছিলেন। হামলায় কেজিএফ গ্যাং, আলি ও ভাণ্ডারীর বাহিনী ছাড়াও মুখ্য ভূমিকায় ছিল দশ-বারোজন পুরুষ ও মহিলা বাউন্সার। ওই বাউন্সাররাই সেবক হাউসের আবাসিকদের অপহরণ করে ডেরায় ফেরার পথে এনজেপি সহ বিভিন্ন এলাকায় নামিয়ে দেয়।
সেবক হাউসের ভেতরে যে ১৫-২০ জন মহিলাকে পরিকল্পনা করে ঢুকিয়ে দিয়েছিল মাফিয়ারা তারা ইস্টার্ন বাইপাস এলাকার বাসিন্দা। জমি দখলে দীর্ঘদিন থেকেই ওই মহিলাদের ব্যবহার করছে আলি। কিছুদিন আগে ডন বসকো স্কুল লাগোয়া এলাকায় একটি জমি দখল করতে গিয়ে একই কায়দায় জমিতে মহিলাদের ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আলির সঙ্গে পুলিশের একাংশের দহরম-মহরম এতটাই বেশি যে কিছুদিন আগে মাদক পাচারের ঘটনায় সে এসটিএফের এক কর্তা আলিকে চড় কষালে পুলিশের একাংশ আলিকে মদত দিয়েছিল।
সূত্রের খবর, মোট সাত কোটি টাকায় সেবক হাউসের রফা করেছিল হালদার। তার মধ্যে চার কোটি টাকা লেনদেনও হয়ে গিয়েছে। তাই বেকায়দায় পড়েছে ওই মাফিয়া। দিল্লির নেতার ইচ্ছায় এক আইনজীবী মঙ্গলবার থেকে বিভিন্ন মহলে ঘুরছেন। তবে গোটা ঘটনায় নতুন মোড় নিয়েছে শিলিগুড়ির এক কাউন্সিলারের ভূমিকা। বৃহস্পতিবার মিশনের সন্ন্যাসীদের সঙ্গে গোপনে দেখা করেছেন সেই কাউন্সিলার। কী উদ্দেশ্যে তিনি সন্ন্যাসীদের দ্বারস্থ হয়েছিলেন, সেটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন।