- বিদ্যুৎ রাজগুরু
পাড়ার ক্লাবেই তো জীবনের প্রথম কাঁপা কাঁপা গলায়, ‘বর এসেছে বীরের ছাঁদে/বিয়ের লগ্ন আটটা’ কিংবা ‘ কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে…’ আবৃত্তির হাতেখড়ি। কখনও ভুলে যাওয়া নাটকের ডায়ালগে হাততালি। সোহাগে শাসনে সকলের সঙ্গে বড় হওয়া। ‘দেখো আমি বাড়ছি মাম্মি’ গোছের বিজ্ঞাপনের বহরে নয়। কিংবা ঠিকানা থেকেও ঠিকানাহীন হয়ে ‘ছায়াবাজির ছায়ার মতো’ বেঁচে থাকা নয়। আমার পাড়া আমাকে শিখিয়েছে সংঘবদ্ধতার প্রয়োজনীয়তা, দায়িত্ববোধ, মমত্ববোধে একাত্ম হয়ে যাওয়ার বেদমন্ত্র।
ফুটবল, কাবাডি, খো খো, লুকোচুরি- সে যাইহোক, উৎসব অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা কিংবা সমস্যার সমাধানের নিদান শিখেছি পাড়ার অভিভাবকদের কাছে। পাড়ার বয়স্করা যেন সকলের অভিভাবক। চেতনায় দিয়েছি শান। সে শহর কিংবা গ্রাম যেখানে হোক সরস্বতী কিংবা কালী-কার্তিক পুজোর প্যান্ডেল হয়েছে পাড়ার কাকিমা, জেঠিমাদের রংবেরংয়ের কাপড় দিয়েই। পুজোর বাজারে নতুন জামাকাপড়ের গন্ধে বিভোর হয়ে থাকতাম কয়েকটা দিন।
যৌথ পরিবারের সদস্য হিসাবে দেখেছি পুজোর বাজার দেখতে গোটা পাড়া হুমড়ি খেয়ে পড়ত ঘরে ঘরে। শহর সভ্যতার আধুনিকতায় এক ঝাঁক অভিভাবকহীন প্রজন্মকে দেখি বীভৎস পোশাকে মোটরবাইকের বিকট আওয়াজে পাড়ার পবিত্রতা নষ্ট করছে। প্রমত্ত সিটিমারার উল্লাসে ভেঙে দিচ্ছে পাড়ার ঐতিহ্যের চিরাচরিত নির্মাণ। তখন মনে হয় এ পাড়া আমার পাড়া নয়। পাড়ায় পাড়ায় যেন আজ বেপাড়ার রাজ।
বড়মা, আরিমা, রেণুমা, রাঙামা, কাকিমা’রা যেন সকলের মাতৃরূপা নারী হয়ে অপশক্তি থেকে পাড়ার সব প্রজন্মকে রক্ষা করতেন। একটা শক্ত বাঁধন ছিল সর্বত্র। আজ সেই বাঁধন যেন আলগা হয়ে যাচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে পাড়া সংস্কৃতি। অজান্তেই আমরা এক সূচিভেদ্য অন্ধকারের দিকে নিক্ষিপ্ত হচ্ছি। ‘ খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে…’ বিলাসিতার উগ্র উত্তেজনায় আর আত্মকেন্দ্রিকতার যাপনে সত্যিই খোকা নয় পাড়াই যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। আজকে যেন বৃষ্টি ভেজা দুপুরগুলো ভীষণ বোকা মনে হয়।
সামাজিক সংস্কৃতির স্তম্ভ ছিল গ্রাম। বিভিন্ন জাতিধর্মবর্ণনির্বিশেষে বাস করেছে চিরকাল। ধর্মীয় উৎসব হয়ে গিয়েছে সর্বজনীন। কিন্তু বর্তমানে পাড়ার সেই পরম্পরায় ভোট রাজনীতি যখন ছোবল মারে, ভয়টা হয় তখনই। প্রতিবেশীর বিপদ মানে সকলের বিপদ। বিবাহ উৎসবের আয়োজন ও তদারকির দায়িত্বে থাকতেন বয়স্করা। পাড়ার সমস্যা মেটাত পাড়ার মানুষজন। এখন সবাই সবজান্তা।
‘পাড়ার ছেলে স্নানের ঘাটে জল ছিটিয়ে সাঁতার কাটে’ কিংবা ‘আজ মঙ্গলবার। পাড়ার জঙ্গল সাফ করবার দিন। সব ছেলেরা দঙ্গল বেঁধে যাবে। রঙ্গলাল-বাবুও এখনি আসবেন।’ কবিগুরুর সহজ পাঠের এই চরম সত্যকথাগুলি খুবই সময়োপযোগী মনে হয় এখনও। সত্যি এ যুগের পাড়াগুলো কিন্তু আজও জঙ্গলময়-জঞ্জালময়। এই জঙ্গল আত্মকেন্দ্রিকতার- এই জঙ্গল অপসংস্কৃতির। তাই আমাদের সাধের পাড়া পূতিগন্ধময়। সত্যিকারের সাফ করার সময় এসেছে। সুকুমার রায়ের ছড়ায় হারানো আমার পাড়াকে খুঁজে পাই, ‘পাড়ার লোকের ঘুম ভাঙিয়ে আয় রে সবাই জুটি, গ্রীষ্মকালের দুপুর রোদে গাছের ডালে উঠি/ আয় রে সবাই হল্লা করে হরেক মজা লুটি/একদিন নয়, দুইদিন নয়, দুই দুই মাস ছুটি।’
(লেখক ফাঁসিদেওয়ার নজরুল শতবার্ষিকী স্কুলের শিক্ষক)