গৌরহরি দাস, কোচবিহার: ইচ্ছে করলে আর পাঁচটা বয়স্ক মানুষের মতো তিনিও ঘরে শুয়েবসে, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে আরামে দিন কাটাতে পারতেন। কিন্তু গরিব মানুষের জন্য তাঁর প্রাণ কাঁদে। তাই ৭১ বছর বয়সেও শীর্ণকায় শরীর নিয়ে পাঁপড়, ভুজিয়া, ধূপকাঠির ব্যাগ হাতে নিয়ে তিনি ফেরি করতে বেরিয়ে পড়েন। দিনভর ফেরি করে ৪০০–৫০০ টাকা আয় হয়। সবটাই গরিবদের সেবায় বিলিয়ে দেন। প্রচারের আড়ালে থেকে প্রায় ১১ বছর ধরে এমন নিঃশব্দ আন্দোলন চলছে। মাঙ্গিলাল বোথরা কোচবিহার শহরের এনএন পার্ক সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা। তবে এই বৃদ্ধ কী কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছেন তা কোচবিহারবাসীর বিলক্ষণ জানা আছে। যে কারণে মাঙ্গিলাল কোনও বাড়িতে ফেরি করতে গেলে কেউ তাঁকে চট করে ফেরান না।
মাঙ্গিলাল চা-বিস্কুট খেয়ে প্রতিদিন সকাল ৯টায় ব্যাগ নিয়ে ফেরি করতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। এরপর দিনভর ফেরি করে বেলা সাড়ে ৩টা নাগাদ বাড়িতে ফিরে সামান্য ডাল-ভাত সবজি খান। তার ১০–১৫ মিনিটের মধ্যেই ফের বাড়ি থেকে ফেরি করতে বেরিয়ে পড়েন। রাত ১০টা নাগাদ বাড়ি ঢোকেন। রাতে আর কিছু খান না। রবিবার সন্ধ্যা নাগাদ শহরের আরআরএন রোডের ধারে থাকা একটি পার্কে তাঁকে নানা সামগ্রী ফেরি করতে দেখা গেল।
তাঁর নিঃশব্দ সমাজসেবার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বৃদ্ধ বলে চলেন, ‘বছর দশেক আগে আমার মা মারা গিয়েছেন। আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকায় মায়ের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র সেভাবে কিনতে পারিনি। মায়ের ওষুধ, পথ্য কেনার জন্য অনেকের কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম। কিন্তু কারও কাছ থেকে সেভাবে সাহায্য পাইনি। তারপর থেকেই গরিবদের সেবা করাটা নিজের পণ করি। প্রতিদিন যে টাকা রোজগার করি তার একটি পয়সাও বাড়ি নিয়ে যাই না। প্রতি রাতে আমি হাসপাতালে যাই। যাঁরা অর্থাভাবে ওষুধ কিনতে পারছেন না, তাঁদের কাছ থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে যতটা পারি ওষুধপত্র কিনে দিই। রাস্তায় কেউ খাবার খেতে চাইলে তাকে হোটেলে নিরামিষ ভাত খাওয়াই। গরিব পরিবারের ৩৮টি মেয়ের বিয়ের জন্য সমস্ত পোশাক কিনে দিয়েছি।’ এই বিয়ের কাজে সাহায্যে মাঙ্গিলাল দুজন ব্যবসায়ীকেও পাশে পেয়েছেন।
রোজগারের সব টাকা বিলিয়ে দিলে সংসার চলে কী করে? মাঙ্গিলাল হাসেন, ‘স্ত্রী, এক ছেলে, পুত্রবধূ, দুই নাতি–নাতনি নিয়ে আমার সংসার। ছেলে একটি বেসরকারি সংস্থায় বছর দশেক ধরে কাজ করে। সংসারের সমস্ত খরচ ওই চালায়। এমনকি হাতখরচ হিসেবে আমাকে ও প্রতি মাসে দেড় হাজার টাকা করে দেয়।’ পুত্রগর্বে গর্বিত বাবার ঘোষণা, ‘যতদিন বাঁচব, সবার জন্য এভাবেই কাজ করে যাব।’