নাগরাকাটা: বাগান বন্ধ হলে যে দুর্দশা নেমে আসে, তা কেবল ভুক্তভোগী শ্রমিকরাই জানেন। নতুন জীবনের সন্ধানে আজন্মের লালিত সেই ভিটে মাটি ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার উপায়ও কারও থাকে না। পড়ে থাকে কেবল বেঁচে থাকার যন্ত্রনার নানা করুণ কাহিনী। যার কিছুটা কখনও প্রকাশ্যে আসে। বাকিটা চাপা পড়ে থাকে শ্রমিক মহল্লার তস্য গলিতেই। সেই পরিস্থিতিকেই একসূত্রে গেঁথে এবার তথ্যচিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছে ডুয়ার্সের চা বাগানের শ্রমিক পরিবারের ৩ যুবক। অতর্কিতে ঝাঁপ পড়া এক সময়ের বহু চর্চিত মালবাজারের সোনালি চা বাগানের পুরোনো গল্পকে উপজীব্য করে তুলে ওই তথ্যচিত্র আদতে গোটা উত্তরবঙ্গের দুটি পাতা, একটি কুঁড়ির রাজ্যেরই আখ্যান। যাতে থাকছে নতুন পথে এগোনোর বিকল্পের সন্ধানও। আর কয়েক মাসের মধ্যেই সাদরি, হিন্দি ও বাংলা এই তিন ভাষাতেই তৈরি তথ্যচিত্রটি দিনের আলো দেখতে চলেছে। এখন চলছে জোরকদমে শুটিং-এর কাজ। যারা এই উদ্যোগে সামিল হয়েছে তাঁদের অন্যতম জন ওরাওঁ নামে এক কলেজ পড়ুয়া সোনালি চা বাগানেরই বাসিন্দা। ওই যুবকের কথায়, ‘সোনালি বন্ধ হোক কিংবা সামসিং। রুটি রুজি না থাকলে শ্রমিকদের পরিস্থিতি যে কী হয় তা একমাত্র তাঁরাই জানেন। তথ্যচিত্রে সেই দুর্দশা যেমন থাকছে। ঠিক তেমনই বন্ধ থাকার অভিশাপকে দূরে ঠেলে কীভাবে সমবায়ের মাধ্যমে সোনালির শ্রমিকরা ইতিহাস গড়েছিলেন সেটাও তুলে ধরা হচ্ছে প্রামাণ্য নথির ওপর ভিত্তি করে।‘
ঠিক কী হয়েছিল ওই বাগানটিতে? সংশ্লিষ্ট সূত্রেই জানা গিয়েছে, চলতি বছর যেমন বোনাস বিতর্কের জেরে এখনও পর্যন্ত উত্তরের পাহাড়, ডুয়ার্স ও তরাইজুড়ে ১৫টি বাগান বন্ধ হয়েছে। ঠিক তেমনই বোনাস ইস্যুতেই ১৯৭৩ এর ২৪ সেপ্টেম্বর সোনালী বাগান বন্ধ হয়ে যায়। টানা এক বছর দুঃসহ দারিদ্রতার সঙ্গে ঘর করার পর দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া শ্রমিকরা এরপর ১৯৭৪ এর ৬ সেপ্টেম্বর গড়ে তোলেন সমবায়। প্রথমে ৩২ জন শ্রমিককে নিয়ে তৈরি ওই সমবায়ে এরপর যোগ দেয় ৩৫০ শ্রমিকের প্রত্যেকেই। ১৯৭৮ এর ৯ জুলাই পর্যন্ত শুধু সাফল্যের সঙ্গেই সাওগাঁও (বাগানটির পুরোনো নাম) টি অ্যান্ড অ্যালায়েড প্ল্যান্টেশন ওয়ার্কাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি চলেছিল তা কিন্তু নয়। ১৯৭৭ সালে শ্রমিকদের ২০ শতাংশ হারের বোনাস দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে। জলপাইগুড়ি সমবায় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ৪০ হাজার টাকায় কিনে নেয় একটি নতুন জিপ গাড়ি ও ৬৪ হাজার টাকায় কাঁচা পাতা বহন করার জন্য ট্রাক্টর। মহিলাদের পড়াশোনার ব্যবস্থাও করে ঐক্যবদ্ধ শ্রমিকরা। ১৯৭৬ এ কর্মক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সম মজুরি আইন পাশ হওয়ার আগেই ১৯৭৪ সাল থেকেই সেখানে সমস্ত শ্রমিকের মজুরি সমান দেওয়া শুরু হয়। তথ্যচিত্রে দেখানো হচ্ছে বাগান বন্ধ হওয়ার পর খোলার দাবিকে তিস্তা নদী পেরিয়ে পায়ে হেঁটে শ্রমিকদের জলপাইগুড়ির জেলাশাসকের দপ্তরে ধর্নায় যাওয়ার সেই রোমহর্ষক দৃশ্যও।
সোনালির সোনালি ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে এখনও সেখানে কয়েকজন বেঁচে আছেন। তাঁদেরই একজন সমবায়টির ভাইস চেয়ারম্যানের পদে থাকা মাট্টু ওরাওঁ। বার্ধ্যকের ভারে নুইয়ে পড়লেও এখনও স্মৃতি শক্তি সমান সতেজ। তিনি বলেন, ‘সোনালি পেরেছিল। অন্য বন্ধ বাগানও একই পন্থা অনুসরণ করলে অবশ্যই পারবে। তবে দরকার প্রশাসনিক সহযোগিতা, শ্রমিকদের সদিচ্ছা ও রাজনৈতিক অনুকম্পা।‘ ওই তথ্যচিত্রের নির্মাতা অন্য দুই যুবকের মধ্যে শরত তিরকির বাড়ি চুয়াপাড়া ও প্রবীর ভগত এর বাড়ি বীরপাড়া চা বাগানে। একই সুরে তাঁরা বলছেন, সোনালির অতীতকে প্রতীকী হিসেবে ব্যবহার করে আমাদের লক্ষ্য গোটা চা বলয়ের বন্ধ বাগানের ছবিকে মূর্ত করে তোলা। তথ্যচিত্রটির অন্যতম নির্মাতা সমাজকর্মী রূপম দেব। তিনি বলেন, ‘এমন একটি উদ্যোগ বর্তমান চা শিল্পের পরিস্থিতিতে অত্যন্ত জরুরি ছিল। যে কারণে ওঁদের যতটা পারছি সহযোগিতা করছি। এই কাজে আর্থিক সহযোগিতা করে বাগান যুবকদের সহযোগিতা করছেন টাইম ফর টি নামে চা বাগান নিয়ে লেখা একটি বহুল প্রচলিত বইয়ের লেখিকা ও ক্যালিফর্নিয়ার স্ক্রিপস কলেজের অধ্যাপিকা পিয়া চট্টোপাধ্যায়।‘