নয়াদিল্লি: ৩২ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল সংক্রান্ত অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশে স্থগিতাদেশ দিয়ে তা কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে নতুন করে শুনানির জন্য ফেরত পাঠিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু কোন পথে এই জয় এল প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ ও মামলাকারী চাকরিহারাদের? শুক্রবার শীর্ষ আদালতে মামলাটির শুনানি শুরু হলে মামলাকারীদের তরফে প্রবীণ আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেন, ‘রাজ্যে ৩২০০০ শিক্ষকের চাকরি খারিজ করা হয় কোন শুনানি না করেই।’ মামলাকারীদের অপর আইনজীবী মুকুল রোহাতগির দাবি, ‘আমরা সাত বছর ধরে চাকরি করছিলাম৷ তারপরও আমাদের চাকরি খারিজ করা হয়েছে৷ আমাদের কোনও বক্তব্য রাখার সুযোগ দেওয়া হয়নি৷ এরপর, ৬৪ হাজার শিক্ষক মামলা করবে শীর্ষ আদালতে৷’ এ প্রসঙ্গে বিচারপতি বিশ্বনাথন জানতে চান, আর কতদিন লাগবে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া শেষ করতে? এর জবাবে মুকুল রোহাতগি জানান, ‘তিন মাস৷’ মামলাকারী পক্ষের অপর আইনজীবী পি এস পাটোয়ালিয়া আদালতকে বলেন, ‘সহকারী শিক্ষকদের মধ্যে আমরাও আছি, যাদের অ-প্রশিক্ষিত বলা হচ্ছে। শিক্ষিতদের জন্যও একই অবস্থা। ৪২,০০০ শূন্য পদ ছিল। সবাইকে ছুড়ে ফেলা হয়েছে। এমনকি শিক্ষিতদের চাকরি গিয়েছে।’ এই বক্তব্যে শীর্ষ আদালতে দুই বিচারপতি কলকাতা হাইকোর্টের পদ্ধতি নিয়ে অনাস্থাপ্রকাশ করেছেন বলে দাবি শীর্ষ আদালত সূত্রে।
শীর্ষ আদালত সূত্রে দাবি, মামলাকারীদের পক্ষে সওয়াল করে আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় জানতে চান, শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কোন যুক্তিতে এভিডেন্স অ্যাক্ট এর ১২৫ ধারা লাগু করা হয়? মুকুল রোহাতগির বক্তব্য, ‘আট বছর পরে লাগাতার এক-একজন আধিকারিককে আদালতে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হয় বলুন সেই সময়ে কি হয়েছিল। কিভাবে নিয়োগ করেছিলেন আপনারা?’ কল্যাণ এও বলেন, ‘সেই আধিকারিকদের উত্তর শুনে হাইকোর্টে মহামান্য বিচারপতি (জাস্টিস গঙ্গোপাধ্যায়) দাবি, আপনি ভয় পেয়ে সব মিথ্যে কথা বলছেন। রাজনৈতিক চাপে বয়ান দিচ্ছেন।‘ মুকুল রোহাতগির এ বিষয়ে সংযোজন, ‘প্রতিটি মামলায় শিক্ষকদের চাকরি গিয়েছে, তাদের কোনও বক্তব্য রাখার সুযোগ না দিয়েই। অথচ বিচারপতি টিভি সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন, ‘আমি দুর্নীতি গোড়া থেকে উপড়ে ফেলব, সবার চাকরি যাবে। ওঁর বিরুদ্ধে দেশের প্রধান বিচারপতির কাছে লিখিত অভিযোগ জানানো হয়। প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ আদেশ দিয়েছিলেন, তারপরে ওনার হাত থেকে নিয়োগ সংক্রান্ত মামলা অন্য বেঞ্চে স্থানান্তরিত করা হয়। কারও কথা না শুনেই কিভাবে চাকরি খারিজ করা হয়? এটা চূড়ান্ত অনৈতিক।’
উক্ত প্রসঙ্গেই বিচারপতি জে কে মাহেশ্বরী নতুন করে নিয়োগ পদ্ধতির বিষয়ে জানতে চাইলে, আদালতে উপস্থিত প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের আইনজীবী জয়দীপ গুপ্ত বলেন, ‘এটি পাহাড় প্রমাণ কাজ। ১ লক্ষ ২০ হাজার প্রার্থীর পুনরায় ইন্টারভিউ নেওয়া যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ, কোটি কোটি টাকা খরচ হবে এই কাজ করতে গেলে।’ তিনি এও বলেন, ‘বিচারপতি বলতে পারেন না, কাকে কাকে সাক্ষাৎকারে কিভাবে ডাকা হবে?’
অপ্রশিক্ষিত প্রার্থীদের তরফে আইনজীবী তরুণ জ্যোতি তিওয়ারি অভিযোগ করেন, ‘রাজ্যের প্রাথমিক নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে৷ শিক্ষা মন্ত্রী জেলে, বোর্ডের সভাপতি জেলে৷ নগদে কোটি কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রীর বান্ধবীর বাড়ি থেকে৷ বিষয়টিকে হালকা ভাবে নেওয়া যাবে না কিছুতেই।’ বিচারপতি মাহেশ্বরী অবশ্য বলেন, ‘আমরা এ নিয়ে কোনও রোভিং এনকোয়ারি করতে পারি না৷’ তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘মনে হচ্ছে শিক্ষা এখন স্বাক্ষরতার পর্যায়ে নেমে এসেছে৷ যারা আবেদন করেছে তাদের বক্তব্য রাখার সুযোগ অবশ্যই দিতে হবে। বিচারপতি মাহেশ্বরীর মতে, কলকাতা হাইকোর্ট যখন বিষয়টি দেখছে তখন তাদেরকেই দেখতে দেওয়া হোক৷ আমাদের মনে হয় দ্রুততার সঙ্গে পুরো বিষয়টির নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গল জাজ বেঞ্চ (পড়ুন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়) যে পদ্ধতিতে বিষয়-টি পরিচালনা করেছে তা যুক্তিগ্রাহ্য নয়। এর পরেই কলকাতা হাইকোর্টের এনিয়ে পূর্ববর্তী যাবতীয় নির্দেশে স্থগিতাদেশ জারি করে সংশ্লিষ্ট মামলাটিকে দ্রুত শুনানির জন্য কলকাতা হাইকোর্টে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দেন তিনি। একইসাথে বলেন, ‘হাইকোর্টে নতুন ডিভিশন বেঞ্চে নতুন করে মামলার শুনানি হবে। তাঁরা নতুন করে বিচার করবেন এবং উচিত সিদ্ধান্ত নেবেন। শীর্ষ আদালতের নির্দেশে মামলাটি হাইকোর্টের বিচারপতি সৌমেন সেন ও বিচারপতি সুপ্রতিম ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চে যাচ্ছে বলে জানা গিয়েছে।‘
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে প্রথম মামলা হয়েছিল কলকাতা হাইকোর্টে। অভিযোগ ছিল, ওই সময় প্রশিক্ষণ নেননি, এমন অনেকেই চাকরি পেয়েছিলেন। সেই মামলাতেই ইন্টারভিউ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এরপর যাঁরা ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন, তাঁদের ডেকে গোপন জবানবন্দি নেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। সেখানেই উঠে আসে, কোনও অ্যাপ্টিটিউট টেস্ট নেওয়া হয়নি। এরপরই ৩২ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকার চাকরি বাতিলের নির্দেশ দেয় বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের সিঙ্গল বেঞ্চ। তাঁর নির্দেশ ছিল, ৪ মাস পর্যন্ত স্কুলে যেতে পারবেন ওই শিক্ষকেরা, তবে তাঁদের পার্শ্বশিক্ষকদের কাঠামো অনুযায়ী বেতন দেওয়া হবে। পরে ওই শিক্ষক-শিক্ষিকারা ডিভিশন বেঞ্চের দ্বারস্থ হন। বিচারপতি সুব্রত তালুকদার ও বিচারপতি সুপ্রতিম ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চ সেই মামলায় চাকরি বাতিলের নির্দেশে স্থগিতাদেশ দিয়েছিল। তবে পুনরায় ইন্টারভিউ নেওয়ার নির্দেশ বহাল ছিল ডিভিশন বেঞ্চেও। এরপরই সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশ৷ আজ দীর্ঘ সওয়াল-জবাব শেষে কলকাতা হাইকোর্টের পূর্ববর্তী যাবতীয় রায়ে স্থগিতাদেশ জারি করল সুপ্রিম কোর্ট। এই সিদ্ধান্তকে ‘নৈতিক জয়’ বলে স্বাগত জানান বর্ষীয়ান আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়।