গৌতম সরকার: বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য ভারতবর্ষের শাশ্বত ভাবনা। উত্তরবঙ্গেরও। নানা জনজাতি, বর্ণময় সংস্কৃতি, বিবিধ ভাষা ইত্যাদি তো বটেই, প্রকৃতি-পরিবেশ মিলিয়ে আবহমান কাল ধরে সম্প্রীতির ছবি দেখে আসছে উত্তরবঙ্গ। অথচ প্রশাসনিকভাবে বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড না হলেও উত্তরবঙ্গবাসী বরাবর নিজেদের বঞ্চিত-ব্রাত্য ভেবে এসেছেন। তাদের আক্ষেপ, যন্ত্রণা, কষ্টের পাশাপাশি নিজস্ব বৈচিত্রকে গত ৪৩ বছর ধরে নানাভাবে তুলে ধরে চলেছে উত্তরবঙ্গ সংবাদ। এই সময়ে আবার বিচ্ছিন্নতার নানা ভাবনা উসকে উঠেছে উত্তরবঙ্গে।
বঞ্চনাজনিত আক্ষেপ থেকে তো বটেই, কখনও কখনও চক্রান্তের কারণে বিচ্ছিন্নতার ভাবনা চাগার দিয়েছে। এতে বিভিন্ন সময় হিংসা প্রত্যক্ষ করা গিয়েছে পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা জনপদে। ক্ষতির বিভীষিকা উত্তরবঙ্গ দেখেছে বিভিন্নভাবে। গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন, কেএলওর জঙ্গিপনা, গ্রেটার কোচবিহার আন্দোলনে পুলিশকর্তা খুন ইত্যাদি রক্তাক্ত স্মৃতি ভুলে যাওয়ার নয়। এইসব কাম্য না হলেও সংবাদপত্রের ধর্ম মেনে ঘটনাগুলির বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছে উত্তরবঙ্গ সংবাদ। সম্প্রীতিতে এসব যে বিঘ্ন ঘটায় তারও বিশ্লেষণ নৈবর্তিক ভাব করে চলেছে উত্তরবঙ্গ সংবাদ। প্রয়াত ও সুহাসচন্দ্র তালুকদার প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্রটি আজ ৪৪ বছরে পড়ল। তার পথ চলার এই অর্ধশতকের কিছু কম সময়ের মধ্যে উত্তরবঙ্গে কোন উন্নয়ন হয়নি বলা যাবে না। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দপ্তর হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রীর মিনি সচিবালয় কাজ করতে শুরু করেছে, রাস্তাঘাট আগের চেয়ে অনেকগুন ভালো, বাজারে সমস্যা না মিটলেও চাষাবাদ এর পদ্ধতি উন্নত হয়েছে।
বঞ্চনার আক্ষেপ তবু থেকেই গিয়েছে। এখনো যোগাযোগের সমস্যা আছে, চিকিৎসা ব্যবস্থায় সংকট রয়েছে, সর্বোপরি কর্মসংস্থানের সুযোগ কার্যত বিকশিতই হয়নি। এরকম সমস্যা শুধু উত্তরবঙ্গে নয় জঙ্গলমহলে আছে, রাঢবঙ্গেও আছে। উত্তরবঙ্গ সংবাদ মনে করে উত্তরবঙ্গের বাইরের পৃথিবীকেও আপন করে নেওয়া উচিত। উত্তরবঙ্গ সংবাদ ৪৪ বছরে পথ চলার শুরুতে চায় বাংলার সকলের যোগাযোগের সেতু হয়ে উঠতে। মানসিক বিচ্ছিন্নতা অনেক সময় বৈরিতার জন্ম দেয়। উত্তরবঙ্গের অন্দরের সকলের ঐক্যের পাশাপাশি বাইরের সবাইকে নিয়ে চলার মঞ্চ হয়ে ওঠার স্বপ্ন এখন আমাদের চোখে।
সংবাদপত্রের লক্ষ্যপূরণ তখনই হতে পারে যখন পাঠক তাতে শামিল হন। সংবাদমাধ্যমের ওপর নানা বিধি নিষেধ, চাপ ইত্যাদির বর্তমান সময়ে উত্তরবঙ্গ সংবাদ শুধু মানুষের কথা বলে এসেছে। জীবন জীবিকার পাশাপাশি প্রকৃতি বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় সরব থেকেছে বারবার। শুধু মানুষের কন্ঠ হয়ে এগিয়ে চলতে চেয়েছে। আগামী দিনে সেই লক্ষ্যে অবিচল থাকবে তার যাত্রা। ভৌগোলিক সীমানার আঞ্চলিকতায় সীমাবদ্ধ না থেকে ‘বিস্তীর্ণ দুপারের অসংখ্য মানুষের’ কন্ঠ হয়ে থাকতে দায়বদ্ধ আমরা। উত্তরবঙ্গের নানা জনগোষ্ঠীর মানুষ এই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে শামিল হবে, ৪৪ তম প্রতিষ্ঠা দিবসে আমাদের প্রত্যাশা। উত্তরবঙ্গের সমস্ত দাবি পূরণের পাশাপাশি উত্তরবঙ্গের বাইরের কোনও ভূখণ্ডও যাতে পিছিয়ে না থাকে, সেই আওয়াজ তুলতে থাকব।