ফালাকাটা: পেশায় চাষি, নেশায় কীর্তনিয়া। প্রায় পাঁচ দশক ধরে কীর্তন কুঞ্জ তৈরি করছেন বছর সত্তরের পরিমল সরকার। দোলের আগে ও দোলের সময় গ্রামগঞ্জে লীলাকীর্তন লেগেই থাকে। কোথাও বাড়িতে, কোথাও সর্বজনীন কমিটির মাধ্যমে এই অনুষ্ঠান হয়। সব ক্ষেত্রেই কীর্তনের অনুষ্ঠানে গোটা এলাকার মানুষ শামিল হন। আর এমন অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দুই হল কীর্তন কুঞ্জ। ফালাকাটার শিশাগোড়ে আগামী শনিবার থেকে শুরু হচ্ছে চারদিনব্যাপী কীর্তন। সেখানেই এখন রাত জেগে কুঞ্জ তৈরির কাজে ব্যস্ত পরিমল।
লীলাকীর্তন শুরুর আগেই তৈরি করতে হয় কুঞ্জ। সেই কুঞ্জর ভেতরেই থাকে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি। এই মূর্তি ও কুঞ্জর চারপাশেই হয় কীর্তনের আসর। পরিমল সেই কুঞ্জ জীবনে প্রথম তৈরি করেছিলেন পশ্চিম কাঁঠালবাড়ির জগবন্ধু শিকদারের বাড়িতে। সে পঞ্চাশ বছর আগের কথা। তখন চারটি কলা গাছ দিয়েই রঙিন কাগজ লাগিয়ে কুঞ্জ তৈরি হত। কাগজ কেটেই ষোলো নাম, বত্রিশ অক্ষর লেখা হত। এভাবেই সাজিয়ে তোলা হত কুঞ্জকে।
পরিমলের দাবি, গত পঞ্চাশ বছরে তিনি নিখরচায় পাঁচ শতাধিক কুঞ্জ তৈরি করেছেন। উত্তরবঙ্গের নানা জেলা তো বটেই এমনকি অসমেও এই কাজ করতে যান। যতদিন বাঁচবেন এই কাজ করেই যাবেন, বলছেন পরিমল। কিন্তু এখনকার প্রজন্মের কেউ কুঞ্জর কাজে আগ্রহ দেখিয়ে এগিয়ে আসছে না বলে তাঁর আক্ষেপ।
পরিমলের বাড়ি শিশাগোড়ের পাশের গ্রাম মেজবিলে। চাষের কাজই জীবিকা। তবে সেই কুড়ি বছর বয়স থেকে তাঁর বাড়তি আগ্রহ কীর্তনে। যদিও কীর্তন পরিবেশন করতে তাঁকে দেখা যায় না। তবে কীর্তন শোনেন। আর কুঞ্জ বানাতে সর্বত্র পরিমলের ডাক পড়ে। আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার জেলার একাধিক কীর্তনের অনুষ্ঠান শুরুর আগে কুঞ্জর কাজের জন্য আমন্ত্রণ পান পরিমল।
পরিমলের হিসেব বলছে, বছরে গড়ে দশটি কুঞ্জ তো তিনি তৈরি করেন। কোনও বছর বেশিও হয়। এই হিসেবেই গত পাঁচ দশকে ৫০০-রও বেশি কুঞ্জ তাঁর হাতে তৈরি হয়েছে। তবে কুঞ্জ কিন্তু স্থায়ী মঞ্চ নয়। কীর্তন শেষ হলেই কুঞ্জ ভেঙে ফেলার নিয়ম। তাই প্রতিবার এমন কুঞ্জ তৈরি করতে হয়।
তবে এখন কুঞ্জর কাজেও পরিবর্তন এসেছে। পরিমল জানালেন, আগের মতো বড় কলাগাছ মেলে না। ছোট গাছে সাজানো যায় না। তাই নামমাত্র ছোট কলাগাছ দিলেও চারপাশে বাঁশের খুঁটি, থার্মোকল, প্লাস্টিকের ফুল, আর্ট পেপারের নানা নকশা দিয়ে কুঞ্জ সাজানো হয়।
তাঁর কথায়, ‘এখন কুঞ্জর কাজে এটাই পরিবর্তন৷ তবে এখনও ষোলো নাম বত্রিশ অক্ষর লিখতেই হয়।’ দিনে চাষের কাজ করেন। তাই রাতের দিকেই কুঞ্জ তৈরির কাজ করেন। তবে এই কাজে কখনও পারিশ্রমিক নেন না৷ একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রম। তবে যখন যেখানে কাজ করেন তখন আয়োজকদের কেউ কেউ সাহায্য করেন বলে তিনি জানিয়েছেন।