Sunday, May 5, 2024
Homeরাজ্যউত্তরবঙ্গহাতিদের ‘অনুপ্রবেশ’ কি আচমকাই? কী জানাচ্ছে বন দপ্তর…

হাতিদের ‘অনুপ্রবেশ’ কি আচমকাই? কী জানাচ্ছে বন দপ্তর…

শুভজিৎ দত্ত, নাগরাকাটা: হাতির দল ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে।  ভুল বলা হল। আসছে নিজেদের ডেরাতেই। মানুষই সেখানে জবর দখলকারী! সম্প্রতি ৬টি হাতি টানা দুইদিন ধরে কোচবিহার জেলার একাধিক স্থানে দাপিয়ে বেড়ানো ও সেই সঙ্গে চারজনের মর্মান্তিক অকাল মৃত্যুর পর প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে তবে কি ওই বুনোদের কাছে উত্তরবঙ্গে আর কোনও স্থানই আন টাচড বা স্পর্শহীন বলে কিছু থাকবে না? এককথায় এর কোনও উত্তর নেই। তবে চরম সত্য এটাই, হাতি নিজেদের বিচরণভূমিতেই রয়েছে। বরঞ্চ আমরাই ঢুকে পড়েছি ওদের আদি ডেরায়। এক মাসের মধ্যে হাতির হামলায় মাদারিহাট-বীরপাড়া  ব্লকে ৫ জন, নাগরাকাটায় ২ জন বা বন দপ্তরের কার্সিয়াং ডিভিশনেও একাধিক মৃত্যুর আসল কারনের বিশ্লেষণে এমন কথাই উঠে আসতে শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট নানা মহল থেকে।

জলদাপাড়ার জঙ্গল থেকে বেরিয়ে পাতলাখাওয়া হয়ে ভেটাগুড়ি, শীতলকুচি, গোসানিমারী, মাথাভাঙ্গা, ঘোকসাডাঙ্গার মতো বিভিন্ন স্থানে হাতির ওই ছোট দলটি কোচবিহারে দুইদিনে অন্তত ১৫০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে। খুব স্বাভাবিকভাবেই এভাবে এলাকায় হাতির আগমন দেখতে একেবারেই অনভ্যস্ত সেখানকার বাসিন্দাদের কাছেই শুধু নয়। আমজনতার কাছেও কার্যত বিরল এই ঘটনাকে নিয়ে চাঞ্চল্য ও উদ্বেগ দুই-ই ছড়ায় গোটা উত্তরেই। তার ওপর একের পর এক মৃত্যু। ইতিহাস অবশ্য বলছে কোচবিহারও একসময়ে হাতিদের বিচরণভূমি ছিল। বহু বছর ধরে হয়তো হস্তীযূথের এমন প্রবেশ ঘটেনি। এখন কোনও কারণে এসে পড়েছিল। ফারাক শুধু এটুকুই। প্রখ্যাত হস্তি বিশেষজ্ঞ পার্বতী বড়ুয়ার কথায়, ‘রাজাদের শিকার ডায়েরির রূপে যে বইটি রয়েছে সেটা খুঁটিয়ে পড়লেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।‘ এপ্রসঙ্গে তিনি উদাহরণ টানছেন আটের দশকে মেদিনীপুরের মত তথাকথিত হাতির বাসভূমি নয় এমন ভার্জিন এলাকাতেও ওই বুনোদের ঢুকে পড়ার পুরোনো কাহিনীর।

প্রকৃতপক্ষে হাতি যাযাবর প্রাণী। এক স্থানের জঙ্গলে বেশিদিন থাকে না। এর মূল কারণ দুটি। প্রথমটি জৈবিক। ওপরটি শারীরিক। যাতায়াত দলবেঁধে শৃঙ্খলিতভাবে। মার্তৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় চলা একেকটি পালে শতাধিক হাতি থাকার দৃষ্টান্তও ভুরিভুরি। উত্তরবঙ্গের বনভূমির বুক চিরে যে হাতিগুলি চলাচল করে সেগুলির করিডর অসম থেকে নেপাল পর্যন্ত বিস্তৃত। যাতায়াতের ওই পথের বহু অংশই এখন ইট-কংক্রিটের জঙ্গলে রুদ্ধ। ফলে খন্ডিত করিডরে বাঁধা পেয়ে সেগুলির লোকালয়ে হানাদারি  নিত্যদিনের ঘটনা। এখন যেখানে ঢুকছে আজ থেকে ৫০-৬০ বছর আগে সেখানে হয় ঘন জঙ্গল ছিল। অথবা গড়ে ওঠে নি আজকের মত অজস্র বাড়িঘর, রেল লাইন, রাস্তা, দোকানপাট কিংবা অন্য কোন অবকাঠামো। ফলে পথ ছিল মসৃণ। এখন সেই করিডর বন্ধ দেখে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছে প্রখর স্মৃতি শক্তির অধিকারী হাতিগুলি। যাদের সংখ্যা উত্তরবঙ্গে এখন কম করে হলেও ছয়শো।

একটা চালু কথা রয়েছে, হাতি যে পথে একবার যায় তা  কখনও ভোলে না। কোচবিহার জেলায় হাতিদের অকস্মাৎ এই ‘অনুপ্রবেশ’ নতুন প্রজন্ম কিংবা মাঝবয়সীদের কাছে অত্যাশ্চর্য ঠেকলেও বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞদের কাছে নয়। সেখানে হাতিদের কোনও বিরাট পাল কিন্তু ঢোকেনি। যে হাফ ডজন ঢোকে এককথায় তাঁরা অবাধ্যতার কারণে নিজেদের দল থেকে খেদানো। এদেরকে বলা হয় ‘মালজুরিয়ান’। সবকটিই পুরুষ।  এমন হাতি অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি আগ্রাসী। মালজুরিয়ানদের ঠেকানো অভিজ্ঞ বনকর্মীদের কাছে তাই সবসময়েই চ্যালেঞ্জিং।

দিনহাটা, মাথাভাঙ্গাতেও হাতি ঢোকার পর এখন অনেকেই বলছেন তরাইয়ের খড়িবাড়ি ব্লকে একটা সময়ে কস্মিনকালেও ওই জন্তুর দেখা মিলত না। এখন সেখানেও ওদের প্রবেশ আকছার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানেও সেই একই যুক্তি। আগে দেখা মেলেনি মানে এই নয় যে কখনও আসবে না। আসলে সবই তো ছিল বুনোদের বাসভূমি। কাঠামবাড়ি, টাকিমারির মতো এলাকায় শুধু জঙ্গলই ছিল। এখন সবুজ উপড়ে স্রেফ বাড়িঘর। এর অব্যবহিত ফল হিসেবে ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসা বন তো রয়েইছে। নিজেদের পুরনো ডেরায় আসলেই আমরা মানুষরা অনায়াসে দোষ চাপিয়ে দিচ্ছি হাতিদের ওপর। ভাগ্যিস ওরা কথা বলতে পারে না! নয়ত টিভির সান্ধ্যকালীন প্যানেল ডিসকাসনে সেজেগুঁজে হাজির রাজনৈতিক নেতাদের মতই কলতলার ঝগড়া বেঁধে যেত। হাতি কোথায় যাবে এটা একমাত্র ওদের ওপরই নির্ভর করছে। নয়তো গরুমারার জঙ্গলের রেডিও কলার পড়ানো দাঁতালের হঁদশ কি আর দুই খরস্রোতা নদী পেরিয়ে ঢোকা মেঘালয়ের গারো পাহাড় এলাকায় মেলে।

ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ তল্লাট এখন হাতিদের মুক্তাঞ্চল। প্রতিদিনই সম্পদহানি থেকে শুরু করে প্রায়শই হতাহতের ঘটনা ঘটছে। শুধু যে মানুষই মারা যাচ্ছে তা কিন্তু নয়। বেঘোরে প্রাণ যাচ্ছে হাতিদেরও। সব মিলিয়ে এই দ্বৈরথের পারদ উর্দ্ধগামী। সমস্যা সমাধানের সঠিক উপায় শুধু হাতড়ে বেড়ানো ছাড়া কারোরই যে কিছু করার থাকছে না ঘটনা পরম্পরাতেই পরিষ্কার। উত্তরের বিশিষ্ট পরিবেশপ্রমী অনিমেষ বসু মনে করেন, এখানে এক সময় বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে জঙ্গল ছিল। হাতি সহ বন্য প্রাণীদের অবাধ বিচরনও ছিল। সেসব আমরা বহুদিন আগেই ইতিহাসের পাতায় পাঠিয়ে দিয়েছি।

এখন আর সেটাকে মাথায় রেখে বন্যপ্রাণীদের জঙ্গল থেকে অধিক দূরত্বের সেই ‘ইতিহাস’ এর জায়গায় আর  পৌঁছতে দেওয়া যাবে না। কারণ বুনোরা জঙ্গল থেকে বেরোলেই বর্তমানে হাজার হাজার মানুষের দখলভূমি অতিক্রম করেই যেতে হচ্ছে। আর সেখানেই সংঘাত।  হয় বন্যপ্রাণীর দ্বারা মানুষের মৃত্যু বা ক্ষতি। নয়তো মানুষের দ্বারা বন্যপ্রাণ আক্রান্ত। অনিবার্য এই সংঘাত ঠেকাতে হাতি, গন্ডার বাইসনরা লোকালয় মুখী হলেই বিলম্ব না করে বন দপ্তর, প্রশাসন, পঞ্চায়েত ও স্থানীয় সেচ্ছাসেবীরা উদ্যোগী হয়ে সত্ত্বর তাদেরকে জঙ্গলে ফেরাতে পারলে তবেই উভয়ের মঙ্গল। আখেরে পুশ ব্যাক ছাড়া আর কোনও বিকল্প হাতে নেই।

Sucharita Chanda
Sucharita Chandahttps://uttarbangasambad.com/
Sucharita Chanda is working as Sub Editor Since 2020. Presently she is attached with Uttarbanga Sambad. She is involved in Copy Editing, Uploading in website and various social media platforms.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Sandeshkhali | ভাইরাল ভিডিও নিয়ে ফের উত্তপ্ত সন্দেশখালি, গঙ্গাধরের বাড়ির সামনে বিক্ষোভ মহিলাদের

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ ভাইরাল ভিডিও নিয়ে ফের অশান্ত সন্দেশখালি। রবিবার সকালে বিজেপির মণ্ডল সভাপতি গঙ্গাধর কয়ালের বাড়ির সামনে বিক্ষোভ দেখালেন স্থানীয়রা। স্থানীয়দের দাবি,...

জল সমস্যা মেটানোর দাবিতে টোটোপাড়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তালা ঝোলালেন স্বাস্থ্যকর্মীরা

0
মাদারিহাট: পানীয় জলের সমস্যা মেটানোর দাবিতে টোটোপাড়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কর্মীরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তালা বন্ধ করে চলে গেলেন। সমস্যা না মেটা পর্যন্ত তাঁরা ফিরবেন না বলে...

S. Jaishankar | কানাডার থেকে আরও তথ্য চাই! নিজ্জর মামলায় ভারতীয়দের গ্রেপ্তারি নিয়ে প্রতিক্রিয়া...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: খলিস্তানি জঙ্গি হরদীপ সিং নিজ্জর (Hardeep Singh Nijjar) খুনের ঘটনায় ইতিমধ্যেই তিন ভারতীয় সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করেছে কানাডার পুলিশ। ধৃতরা ‘হিট...

Siliguri | জলকষ্টে ভুগতে চলেছে শিলিগুড়ি

0
শিলিগুড়ি: ফের জলকষ্টে (Water Crisis) ভুগতে চলেছেন শিলিগুড়িবাসী (Siliguri)। গজলডোবার কাছে তিস্তার বাঁধ মেরামতির কারণে ১০ মে থেকে ১৫-২০ দিনের জন্য জল সরবরাহ ব্যাহত...

Balurghat | পেরিয়েছে ভোট, রাজনৈতিক দলের পতাকা না খোলায় ক্ষোভ

0
বালুরঘাট: গত ২৬ এপ্রিল বালুরঘাট লোকসভা কেন্দ্রের ভোট হয়েছে। তারপর এক সপ্তাহের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও বালুরঘাট শহর সহ দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন...

Most Popular