Friday, May 17, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়ভীরুদের জন্যই ইন্ডিয়া জোট নড়বড়ে

ভীরুদের জন্যই ইন্ডিয়া জোট নড়বড়ে

  • প্রতীক

জার্মানিতে নাজি পার্টির উত্থান ও পতন নিয়ে মার্কিন সাংবাদিক উইলিয়াম শাইরারের লেখা একখানা বই সারা বিশ্বে সমাদৃত। ‘দ্য রাইজ অ্যান্ড ফল অফ দ্য থার্ড রাইখ’ বইতে শাইরার লিখেছেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর হোহেনজোলার্ন রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ছিল একটা দুর্ঘটনা। কারণ যুদ্ধে পরাজয়ের পর জার্মান সম্রাট সিংহাসন ছেড়ে দেন, ওদিকে বার্লিনে তখন জোরদার সাধারণ ধর্মঘট চলছে। রোজা লুক্সেমবার্গ আর কার্ল লিবনেখটের নেতৃত্বে বামপন্থী সমাজতন্ত্রীরা রাশিয়ার মতো বিপ্লব করে ফেলতে পারে– এই ভয় চেপে ধরে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নেতা ফ্রেডরিশ এবার্ট আর ফিলিপ শাইডেমানকে, যাঁরা চ্যান্সেলার প্রিন্স ম্যাক্স অফ ব্যাডেনও পদত্যাগ করে দেওয়ায়, সেই মুহূর্তে দেশের দায়িত্বে ছিলেন।

শাইরারের মতে, ওঁরা চেয়েছিলেন যেনতেনপ্রকারেণ রাজতন্ত্র বজায় থাকুক। তা হচ্ছে না দেখে বিপ্লবের আতঙ্কেই ১৯১৮ সালের ৯ নভেম্বর তড়িঘড়ি কোনিগসপ্লাৎজের সামনে জড়ো হওয়া জনতার সামনে শাইডেমান ঘোষণা করে দেন– জার্মানি এখন থেকে ‘রিপাবলিক’। সেই রিপাবলিকের সংবিধান ঘোষণা হয় আরও এক বছর পরে ওয়াইমার শহরে আয়োজিত অ্যাসেম্বলি থেকে। তাই তাকে ওয়াইমার রিপাবলিক বলা হয়ে থাকে।

বিপ্লবের সম্ভাবনা দমন করতে যে ওয়াইমার রিপাবলিক দারুণ সফল হয়েছিল সন্দেহ নেই। এমনকি রোজা আর কার্লকেও একেবারে প্রাণে মেরে দেওয়া হয়েছিল জানুয়ারিতেই। কিন্তু এসব করতে গিয়ে গণতন্ত্র যেমন হওয়া উচিত, তেমন করে জার্মানিকে গড়ে তোলার দিকে নজর দেওয়া হয়নি। সামন্তপ্রভু, উচ্চবর্গীয় জার্মান এবং সেনাবাহিনীর লোকজন– যাদের গণতন্ত্র ব্যাপারটা মোটেই পছন্দ ছিল না, তাদের পোষ মানানোর নরম বা গরম– কোনও চেষ্টাই করা হয়নি। ফলে তৈরি হয় এক জগাখিচুড়ি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যেখানে সেনাবাহিনীর যতটা প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকা উচিত তার চেয়ে বেশিই ছিল। সঙ্গে ছিল ক্ষমতাশালী শ্রেণির দুর্নীতি।

সব মিলিয়ে কেমন অবস্থা হয় সাধারণ জার্মানদের? ভাষান্তরে শাইরার বর্ণিত সেই অসহনীয় পরিস্থিতি এইরকম : … তবে জনতা বুঝতে পারেনি যে জার্মান মুদ্রার বিপর্যয়ে বৃহৎ শিল্পপতি, সেনাবাহিনী আর রাষ্ট্র কেমন লাভবান হচ্ছিল। তারা শুধু দেখতে পাচ্ছিল, ব্যাংকে অনেক টাকা থাকলেও খানিকটা গাজর, কিছুটা আলু, কয়েক আউন্স চিনি, এক পাউন্ড ময়দা কেনা যাচ্ছিল না। প্রত্যেক ব্যক্তি জানত, সে দেউলিয়া আর প্রতিদিন খিদের জ্বালা টের পেত। এই যন্ত্রণা আর আশাহীনতার মধ্যে দাঁড়িয়ে তারা সবিকছুর জন্য গণতন্ত্রকে দায়ী করত। …এমন একটা সময় অ্যাডলফ হিটলারের জন্যে ছিল ঈশ্বরপ্রদত্ত।

গত সোমবার কংগ্রেসের সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে ভুবনেশ্বরে সভায় বলেছেন, কিছু নেতা এবং সাধারণ মানুষ যদি ভীরুতা অবলম্বন করেন তাহলে সংবিধান ও গণতন্ত্রের বাঁচা শক্ত। আগেরদিনই নীতীশ কুমার ফের বিজেপির সঙ্গে জোট করে আবার বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়ে ফেলেছেন। ফলে বোঝা শক্ত নয়, খাড়গের আঙুল কার দিকে ছিল। খাড়গে অবশ্য শুধু নীতীশের দিকে আঙুল তুলেও থামেননি। একইসঙ্গে ওডিশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েকেরও নিন্দা করেছেন বিজেপির বিরুদ্ধে না দাঁড়ানোর জন্যে। দেশের সংকট মুহূর্তে কিছু রাজনীতিবিদের ভীরুতার কী দাম একটা দেশকে দিতে হয়, তা শাইরারের বইয়ের যে অংশ নিয়ে আলোচনা করলাম, তা পড়লেই বোঝা যায়। তবে খাড়গে সঠিকভাবেই চিহ্নিত করেছেন, বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে একা নীতীশই ভীরু নন।

বস্তুত, ভীরুদের প্রত্যেককে চিহ্নিত করলে ইন্ডিয়া জোট আরও দুর্বল হয়ে পড়বে, আখেরে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়েরই ক্ষতি হবে– এই আশঙ্কাতেই সম্ভবত খাড়গে আর কারও নাম করেননি। নইলে নিঃসন্দেহে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নামও করতে হত। তিনি ইন্ডিয়া জোটে আছেন, অথচ তাঁর দলের শাসনে থাকা পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যেই ঘোষণা করে দিয়েছেন– পঞ্জাবে তাঁরা একাই লড়বেন, কংগ্রেসকে কোনও আসন ছাড়বেন না।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামও করতে হত। তাঁর দীর্ঘদিনের অভিযোগ ছিল– কংগ্রেস দাদাগিরি করে, কংগ্রেস বিজেপির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াই করার ব্যাপারে আন্তরিক নয়। কংগ্রেস ইন্ডিয়া জোটে এল, তাঁকে জোটের সভায় রাহুল গান্ধির পাশে জায়গাও দেওয়া হল। অথচ কোনও সভায় তিনি নিজে যান না, কখনও কোনও প্রতিনিধিকেও পাঠান না, কখনও আবার সংযুক্ত ঘোষণাপত্রে তাঁর দলের স্বাক্ষর থাকে না।

গত কয়েকদিনে আবার সটান বলে দিয়েছেন, ইন্ডিয়া জোটে আছেন দেশে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে একাই বিজেপির বিরুদ্ধে লড়বেন। ত্রিপুরা, মেঘালয়, গোয়া  নির্বাচনে লড়তে গিয়ে আদৌ সুবিধা করতে না পারার পরেও তিনি রাজ্যের বাইরে নিজেদের শক্তি সম্পর্কে কী করে আত্মবিশ্বাসী হচ্ছেন তা বোঝা শক্ত। রাহুলের ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা মমতার রাজ্যে ঢুকে পড়েছে, অথচ তৃণমূল কংগ্রেসের দিক থেকে তাতে সংগত করার লক্ষণ দেখা যায়নি। উলটে কংগ্রেস অভিযোগ করছে তৃণমূলই নাকি ন্যায় যাত্রার পতাকা ছিঁড়ে দিচ্ছে, রাহুলকে সরকারি গেস্টহাউসে মধ্যাহ্নভোজন করতে দেওয়ার সৌজন্যটুকুও দেখানো হচ্ছে না।

এর পিছনে ইডি, সিবিআই আতঙ্ক ছাড়া অন্য কিছু কি থাকা সম্ভব? এ যদি ভীরুতা না হয়, তাহলে তো ভাবতে হবে সিপিএম নেতারা যে তৃণমূল-বিজেপি সেটিংয়ের তত্ত্ব খাড়া করেন সেটাই সত্যি। নইলে বিজেপি যে দেশের শত্রু, গণতন্ত্রের শত্রু সেকথা তো খাড়গের মতো মমতাও বলে থাকেন। তাহলে মিলেমিশে লড়তে আপত্তি কেন? ইন্ডিয়া জোটে তাঁর চেয়ে বেশি সিপিএমকে গুরুত্ব দেওয়া হয়– এ তো অভিমানের কথা। এ কি মান-অভিমানের সময়? তবু যদি অভিমানের ভিত্তি থাকত! সিপিএমের সাংসদ সংখ্যা তৃণমূলের ধারেকাছে নয়। তাদের নেতা সীতারাম ইয়েচুরি সভায় গুরুত্ব পেলেন কি পেলেন না তাতে কী-ই বা এসে যায়?

রাম মন্দির প্রতিষ্ঠা করেও যে বিজেপি চারশো আসন পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত নয় তা পরিষ্কার। বিরোধীদের ভীরুতাকে তারা হাতিয়ার করতে চাইছে। ইডি, সিবিআইয়ের খাতায় শুধু  নীতীশ বা মমতার দলের নেতা, মন্ত্রীদের নামেই অভিযোগ আছে তা তো নয়। কেরলে সিপিএম নেতা, মন্ত্রীদের গ্রেপ্তার, জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তামিলনাডুতে ডিএমকে নেতাদের বিরুদ্ধেও কার্যকলাপ শুরু হয়েছিল। সম্ভবত স্ট্যালিনের সরকার পালটা এক ইডি অফিসারকে গ্রেপ্তার করায়, মাদুরাইয়ের ইডি দপ্তরে হানা দেওয়ায় উৎসাহে ভাটা পড়েছে। নীতীশ এনডিএতে ফিরে যাওয়া মাত্রই তেজস্বী যাদবকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনকেও গ্রেপ্তার করা হতে পারে বলে হাওয়ায় খবর ভাসছে। ইন্ডিয়া জোটের আরেক শরিক শিবসেনা। তাদের ডাকাবুকো নেতা সঞ্জয় রাউত। তাঁর নামেও মামলা আছে ইডি’র হাতে, তাঁকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। দরকার পড়লে শিবসেনার ভীরুতার পরীক্ষাও নিশ্চয়ই নেওয়া হবে।

এবার্ট আর শাইডেমানের ভূমিকা ভারতে কারা পালন করলেন তা তো এখনই বোঝা যাবে না, স্পষ্ট হবে আজকের ইতিহাস যখন লেখা হবে তখন। কিন্তু কৌতূহল হয়, বিরোধী দলগুলো দুর্নীতিমুক্ত হলে বিজেপি বিরোধী জোটের এমন নড়বড়ে অবস্থা হত কি না। সন্দেহ নেই, যেসব মামলায় বিভিন্ন দলের নেতাকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে তার অনেকগুলোরই ভিত্তি নেই। রাউতকে জামিন দেওয়ার সময়ে যেমন বিচারপতি বলেছিলেন, ওই গ্রেপ্তারি বেআইনি। যে কোনও দেওয়ানি গোলমালকে আর্থিক দুর্নীতির তকমা দেওয়া চলে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক, গত কয়েক দশকে ভারতের প্রায় সব দলের নেতাদের এত আর্থিক কেলেঙ্কারি প্রকাশিত হয়েছে, যে কোন ক্ষেত্রে পালে সত্যিই বাঘ পড়েছে আর কোথায় স্রেফ বিরোধী শক্তিকে গ্রাস করে নিতে কেন্দ্রীয় এজেন্সি ‘চোর চোর’ বলে চ্যাঁচাচ্ছে– তা বোঝা শক্ত। এই ধোঁয়াশার সুযোগ নিয়ে বিরোধী দলগুলোকে ভোটারদের চোখে আরও ছোট করে দেওয়া এবং সম্ভব হলে দলে টেনে আনা চলছে।

হিটলারের অবশ্য ইডি, সিবিআই ছিল না।

(লেখক সাংবাদিক)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Sitalkuchi shootout | ভোট মিটতেই উত্তপ্ত শীতলকুচি, গুলিবিদ্ধ তৃণমূল প্রধান

0
শীতলকুচি: ভোট মিটতেই উত্তপ্ত হয়ে উঠল কোচবিহারের (Cooch Behar) শীতলকুচি (Sitalkuchi)। লালবাজার গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল কংগ্রেস (TMC) প্রধান অনিমেষ রায়কে লক্ষ্য করে গুলি (Sitalkuchi...

Israel-Hezbollah Conflict | ইজরায়েলের সেনাঘাঁটিতে রকেট হামলা হিজবুল্লার

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ইজরায়েলের সেনাঘাঁটি লক্ষ্য করে রকেট হামলা চালাল লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লা। বৃহস্পতিবার রাতে উত্তর ইজরায়েলের লোয়ার গ্যালিলি সেনা এবং বিমানঘাঁটি...

Aishwarya Rai Bachchan | ভাঙা হাতেই কানের রেড কার্পেটে দ্যুতি ছড়ালেন ঐশ্বর্য

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ৭৭তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের দ্বিতীয় দিনে রেড কার্পেটে নজর কাড়লেন বলিউড ডিভা ঐশ্বর্য রাই বচ্চন(Aishwarya Rai Bachchan)। ফাল্গুনি শেন পিককের...
weather update in west bengal

Weather Report | তীব্র তাপপ্রবাহে বাড়ছে অস্বস্তি, সোমেই হাওয়া বদল বঙ্গে

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ফের তীব্র গরমে পুড়ছে রাজ্যবাসী। শনি ও রবিবার উত্তর ও দক্ষিণ দুই বঙ্গের ছয় জেলায় তাপপ্রবাহের সতর্কতা জারি। উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি...

Sex Worker | ঘরের বৌকে যৌনকর্মী হতে চাপ! কাঠগড়ায় স্বামী-শাশুড়ি

0
শিলিগুড়ি: সন্তান জন্মের পর থেকেই বাড়ির বৌকে যৌন ব্যবসায় নামানোর জন্য চাপ দিচ্ছেন খোদ স্বামী ও শাশুড়ি। আর এই অভিযোগকে কেন্দ্র করে শোরগোল পড়ে...

Most Popular