- সানি সরকার
সময়টা ২০০৯-এর সেপ্টেম্বর। নিউ জলপাইগুড়ির রেলওয়ে ইনস্টিটিউট মাঠের সভায় তাঁর মুখে প্রথম শোনা গেল ‘বসন্ত পাখি’ শব্দটি। দর্শকাসন তো বটেই, তৃণমূল নেতারাও পরস্পরের মুখের দিকে তাকাচ্ছেন, বুঝতে চাইছেন বসন্ত পাখি মানে কী? সেসময় কয়েকদিন আগে উত্তরবঙ্গ সফরে আসা রাহুল গান্ধি যে টার্গেট মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের, কারও বুঝতে অবশ্য বেশি সময় লাগেনি তখন।
কিন্তু তাঁর দল তো তখন ইউপিএ’র শরিক এবং তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ রেলমন্ত্রী। এরপরেও কেন সমালোচনার জন্য নিশানা করলেন রাহুলকে? ২০১১-র সলতে পাকানোর জন্য রেলের ‘জমি ব্যবহার’ এবং সংখ্যালঘু ভোটে কংগ্রেসের একচ্ছত্র আধিপত্য ভাঙতে তৃণমূল নেত্রী যে ওই সময় থেকে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন, তা স্পষ্ট হয়ে যায় কয়েকদিনের মধ্যে।
যদিও ২০১১-তে বাংলা দখলে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়েছিল তৃণমূল। তারপর গত দেড় দশকে মহানন্দা-ডাউক-বালাসন দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। অনেক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাক্ষী থেকেছে উত্তরবঙ্গ। দেখা যাচ্ছে, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের প্রেক্ষিতে এখনও তৃণমূল নেত্রীর নিশানায় সেই রাহুল গান্ধিই।
তাছাড়া নজরে সেই সংখ্যালঘু ভোট। তাই ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকার যে যে পথ ধরে এগিয়েছে, সেখানেই যেন বিশেষ নজর মমতার। রাহুলের কর্মসূচির পরদিন না হলেও পরের পরের দিন তিনি পৌঁছে গিয়েছেন সেইসব এলাকায়। খেয়াল করলে বোঝা যাবে, চোপড়া, ইসলামপুরে এত বিস্তারিত কর্মসূচি মমতার পূর্বনির্ধারিত না থাকলেও তিনি রাহুলের পা ন্যায় যাত্রায় বাস থেকে মাটিতে পড়েনি জানতে পেরে সেই এলাকাগুলিতে হেঁটে রোড শো করেছেন নিজের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে।
যদিও বিজেপি, সিপিএমের পাশাপাশি কংগ্রেসের সমালোচনা করলেও রাহুলের নাম মুখে আনেননি একবারও। রাহুল যে গাড়ি থেকে নামেননি, তা ইতিমধ্যে উসকে দিয়ে প্রচার চালানো হচ্ছে তৃণমূলের তরফে। একইসঙ্গে শরীরে নানা চোট-আঘাত থাকলেও মমতা যে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হাঁটছেন, সেটাও প্রচার করা হচ্ছে।
একটি বিষয় তাৎপর্যপূর্ণ। সেটা হল, কংগ্রেসের সঙ্গে বাংলায় তৃণমূলের আসন সমঝোতা বিশবাঁও জলে চলে গেলেও ‘ইন্ডিয়া’ জোট ছাড়ার কথা এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেনি তৃণমূল। অনেকে মনে করছেন, সংখ্যালঘু ভোটে ধরে রাখতে ‘রাহুলকে তাড়া করছেন মমতা।’ ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গের কোথাও কলকে পায়নি তৃণমূল।
আটে সাত জিতে নিয়েছিল বিজেপি। সাংগঠনিকভাবে তেমন শক্তিধর না হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র ধর্মীয় ও জনগোষ্ঠীগত মেরুকরণ ঘটিয়ে বিজেপি এই সাফল্য পেয়েছিল বলে মনে করা হয়। দক্ষিণ মালদা দখলে রেখে কিছুটা আত্মসম্মান ধরে রেখেছিল কংগ্রেস। নির্বাচন পরবর্তীতে পরিষ্কার হয় যে, সংখ্যালঘু ভোট ভাগাভাগিতে বিজেপির কেল্লা ফতে হয়।
এই ভাগাভাগি আটকাতে ২০২০-তেই নজর দিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী। যার ফলও পেয়েছিলেন। ’২১-এর বিধানসভা ভোটে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত প্রতিটি কেন্দ্রে ঘাসফুল ফুটেছিল। ন্যায় যাত্রায় বাস থেকে রাহুল গান্ধির পা মাটিতে না পড়লেও, তাঁর উত্তরবঙ্গ সফর নিয়ে একেবারে নির্বিকার থাকতে পারল না তৃণমূল। দলগতভাবে না হলেও কখনও প্রশাসনকে ব্যবহার করে, কখনও নাগরিক পরিচয়ে বাধা দেওয়া হয়েছে।
আসলে ‘অশনিসংকেত’ সেই সংখ্যালঘু ভোট। রাজ্যের শাসকদলের অনেক প্রবীণ নেতার এখনও দৃঢ়বিশ্বাস, গান্ধি পরিবারের ক্যারিশমা এখনও শেষ হয়ে যায়নি। রাহুল গান্ধির ন্যায় যাত্রায় সংখ্যালঘু ভোট যদি আবার কিছুটা কংগ্রেসের ঝুলিতে ঢোকে, তবে যে আখেরে বিজেপির লাভ, বুঝতে ভুল হচ্ছে না তৃণমূল নেত্রীর। তাই তিনি ছুটলেন চোপড়া থেকে মালদা হয়ে মুর্শিদাবাদ।
তিনি জানেন, চোপড়া থেকে মালদা, আগাগোড়াই অতীতে কংগ্রেসের গড়। রাহুলের ন্যায় যাত্রাকে কেন্দ্র করে যদি ওই এলাকার কংগ্রেস কর্মীরা নতুন করে উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন এবং সংখ্যালঘু ভোটারদের বড় অংশ ফের কংগ্রেসের দিকে ঢলে পড়েন, তবে যে সমূহ বিপদ, সেই ভাবনা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আছে। সেই আশঙ্কা থেকেই আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে তৃণমূল নেত্রী ওই এলাকাগুলিতে ঝটিকা সফর করে গেলেন।