- সাহানুর হক
কোচবিহার জেলার এক শহরের ছবি। এক উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীকে কোচিং থেকে ফেরার পথে তার সহপাঠীকে বলতে শুনলাম, ‘এত পড়াশোনা আর ভালো লাগে না রে! এর থেকে বরং আর একবার করোনা এলে ভালোই হত, পরীক্ষা ছাড়াই পাশ করে যেতাম।’ বড় সহজ উচ্চারণে মাথা নাড়িয়ে সহমত পোষণ করল কোচিং ফিরতি আর পাঁচজন পরীক্ষার্থী। ওদের কারও যেন এই প্রসঙ্গে বিরোধিতার ইচ্ছে দেখা গেল না।
নিতান্তই করুণ এই চিত্রকল্পটি গোটা বাংলা অতঃপর দেশজুড়ে বহু ছাত্রছাত্রীর মনেরই প্রার্থনা যেন। যেখান থেকে স্পষ্ট, বর্তমান প্রজন্মের হালহকিকত।
মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষায় মধ্যশিক্ষা পর্ষদ একদল পরীক্ষার্থীকে চিহ্নিত করেছে, যারা সমাজমাধ্যমে প্রশ্নপত্র ভাইরাল করতে উদ্যোগী হয়। যে কারণে তাদের পরীক্ষাও বাতিল করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হল, শিক্ষার্থীদের মধ্যে এরকম উদ্ভট ভাবনাচিন্তার প্রসার হচ্ছে কেন? কোথায় এর উৎস? এই সমস্যার সমাধানই বা কী হতে পারে? আদৌ কি কোনও পথ আছে?
ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক এবং শিক্ষক- তিন পক্ষের সঙ্গে কথা বললে প্রশ্নগুলোর ব্যাখ্যা তিনভাবে দেওয়া যেতে পারে। এক, ভয়াবহ কোভিড–১৯ দুই বছর ধরে সব ক্ষেত্রে ধ্বংসাত্মক ছাপ রেখেছে। শিক্ষাক্ষেত্র এর ব্যতিক্রম হতে পারে না। চলমান জীবন থেকে আচমকা এই দীর্ঘ সময়ে পড়াশোনার যে গ্যাপ থেকে গিয়েছে সবখানেই, সেই শূন্যতা থেকেই হয়তো ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এই কুপ্রভাব। দুই, করোনা পরবর্তী সময়ে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে চরম পর্যায়ে বেড়েছে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, এই ব্যবহারের ইতিবাচক প্রভাব অপেক্ষা নেতিবাচক প্রভাবগুলো বেশি প্রস্ফুটিত হয়েছে এবং হচ্ছে। তিন, প্রযুক্তি অপেক্ষা আরও জোরালো বিষয়টি হল, পারিবারিক সতর্কতার অভাব ও গুরুজনদের শিক্ষার্থীর প্রতি খামখেয়ালিপনা।
ইউনিসেফের তথ্য বলছে করোনাকালে বিশ্বব্যাপী প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় ৩৮ শতাংশ শিক্ষার্থী মারাত্মক আকারে মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। আজকের দিনে শিক্ষার্থীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ যেন পড়াশোনা অপেক্ষা শুধু ছুটে যেতে চায় বিনোদনের ঝাউবনে। গেম কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় রিলস স্ক্রলে ডুবে থাকতে চায় সারাক্ষণ। এ নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে প্রচুর। কোনও সমাধান বেরোয়নি।
শিক্ষার মরশুমে শিক্ষার্থীদের জীবনে করোনা নামক শীত পেরিয়েও এ যেন এক অকাল কুয়াশা। তাই সবার আগে শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের কথা ভাবতে হবে। এর জন্য দরকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়াশোনার প্রতি মনযোগের পাশাপাশি প্রেম ও শ্রদ্ধার। দরকার সরকারি পদক্ষেপ। জরুরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিশিষ্ট কার্যক্রম ও প্রয়োজন পারিপার্শ্বিক পরিবেশের ভারসাম্য।
জার্মান মনোবিশ্লেষক কারেন হরনির মতে, ‘শিক্ষার্থী যা কিছু শেখে তাই হল পাঠক্রম।’ এই ভাবনা বাস্তবায়ন করতে সব শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঠিক পথে স্বপ্ন নির্মাণে সাহায্য করতে আগ্রহী হতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সমাজকে। ভুলত্রুটির আগেই সমাধান ভেবে রাখতে হবে। প্রজন্মের জন্য ‘পড়াশোনাই জীবনের মূল মন্ত্র ও অস্ত্র’- এই ভাবনাচিন্তায় বাধ্য করাতে হবে শিক্ষার্থীদের। সরস্বতীপুজো আর ক’দিনেই। তাঁর আগমনে সকল দুর্ভাবনা ও দুরাশা কেটে যাক সরস্বতী মন্ত্রের এই উচ্চারণে, ‘বীণা রঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমোহস্তুতে।’
(লেখক দিনহাটার বাসিন্দা)