- রূপায়ণ ভট্টাচার্য
ওখানে দুটি বা তিনটি কাঠবেড়ালিকে দেখা যায় মাঝে মাঝেই গাছ থেকে নিঃশব্দে নেমে আসতে। তারা জানে, ওখানে কিছু খাবার পাওয়া নিশ্চিত এখন। এক হাজার ষাট দিন ধরে তো মানুষের কাছে নিয়মিত টুকটাক খাবার মিলছে সেখানে। বন্ধুত্ব হবে না?
মঙ্গলবারের দুপুর তখন হাঁটা লাগিয়েছে বিকেলের হাত ধরতে। কলকাতা মেয়ো রোড-ডাফরিন রোডের গান্ধিমূর্তির নীচে নৈঃশব্দ্য। সবুজ ঘাসে ত্রিপল পেতে জনা সতেরো তরুণ-তরুণী শুয়ে বসে। স্লোগান নেই, উচ্চকিত কথা নেই। কেউ মোবাইল দেখছে শুয়ে শুয়ে। কেউ শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে। মেয়েদের দিকে এক কিশোরী কোলে গায়ে উঠছে সবার, হাতে চকোলেট। কারও কন্যা হবে। এক তরুণ এসে পাকা কলা বিলোচ্ছে বাকিদের মধ্যে। কাঠবেড়ালিদের নজর কলার খোসার দিকে। পাশ দিয়ে ট্রাক ভর্তি তৃণমূলের মহিলা কর্মীরা যাচ্ছেন রেড রোডে তাঁদের অবস্থানের দিকে। এদিকে কারও ভ্রূক্ষেপ চোখে পড়ল না তো!
কলকাতা ময়দানে উদ্দেশ্যহীন ঘুরলে এখন বুকের ওপর চেপে বসে দুঃখ ও বিস্ময়ের পাথর। আসলে আক্ষরিক অর্থেই দশদিকে ধর্না মঞ্চ। গান্ধিমূর্তির নীচে আরেকটি চাকরিপ্রার্থীদের সংগঠনের দু’তিনজন বসেছিল সেদিন। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, অথচ পথ বাছার অবস্থানেই একরাশ অমিল। রেড রোডে তৃণমূলের অবস্থান তো, শহিদ মিনারের নীচে সরকারি কর্মীদের। মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তির কাছে আরও সাতটি সংগঠনের চাকরিপ্রার্থী পাশাপাশি। চাকরিপ্রার্থীদের বসার জায়গাটাকে ঠিক মঞ্চ বলা উচিত নয়। ওঁরা ত্রিপল পেতে ঘাসের ওপর বসেন প্রতিদিন। এরই মাঝে হাওড়া ইউনিয়ন মাঠে ক্রিকেট চলছে। কর্মহীন সামান্য কিছু দর্শক আগের মতোই লোহার জালের পাশে দাঁড়িয়ে। ফিল্ডারদের চিৎকার উপেক্ষা করে রামায়ণ পাঠ চলছে মাঠের ধারে। শ্রোতা ঠিক চারজন।
এসবের মধ্যেই মাথায় ঘোরে পরপর অনেক পর্যবেক্ষণ। প্রথমত, হাজার দিন অবস্থানের পরেও ছেলেমেয়েগুলোর ক্ষোভ, যন্ত্রণা, হাহাকার নিয়ে মাথাব্যথা নেই কলকাতার। অবস্থানকারীর সংখ্যা কমছে দিন-দিন। এবং সেখানে কোচবিহার-মালদার ছেলেরা পড়ে থাকলেও কলকাতার কেউ নেই। দ্বিতীয়ত, বিভ্রান্ত প্রতিবাদীরা বুঝে গিয়েছেন, শাসকের মতো বিরোধীরাও তাঁদের সমস্যা মেটাতে দারুণ উদ্যোগী নয়। বরং বিরোধীরা ভাবছে, লোকসভা পর্যন্ত সমস্যা ঝুলিয়ে রাখতে পারলে লাভ তাদেরই। গত দু’মাসে বড় বিরোধী নেতারা কেউ আসেননি তল্লাটে। তৃতীয় কারণ, আদালতে বেঞ্চ বদলাতে বদলাতে এত জটিল পরিস্থিতি, কবে আবার কোর্টে মামলা উঠবে, তা নিয়েই বিমূঢ়তা। চার, অবস্থানকারীদের মধ্যেই এত ভাগ, জনতা বিভ্রান্ত হতে বাধ্য। ময়দানে সব মিলিয়ে নয়টি কর্মপ্রার্থী সংগঠনের অবস্থান। ডিভাইড অ্যান্ড রুল–এই পদ্ধতিতে সব শাসকেরই সুবিধে। কেন্দ্র-রাজ্য। পুরোনো শাসকদল, বর্তমান শাসকদল। এই এক জায়গায় সব পার্টির এক নীতি।
পাঁচ নম্বর কারণটা গান্ধিমূর্তির নীচে দাঁড়িয়েই বললেন এক অবস্থানকারী। যিনি ক’দিন আগে মন্ত্রী ব্রাত্য বসুর সঙ্গে বৈঠকে ছিলেন। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘পুরো ঘটনায় এত জটিলতা তৈরি হয়েছে, শিক্ষামন্ত্রীই বিভ্রান্ত। তিনি অতশত খবর রাখেন বলে মনে হল না। ওঁর থেকে বরং কুণালদা বেশি জানেন।’ শিক্ষামন্ত্রীই যদি ভালো করে না জানেন, আপনাদের এখানে লোক কমতে থাকে, তা হলে এতদিনের অবস্থানের ভবিষ্যৎ কী? প্রশ্নটা শুনে তরুণ চাকরিপ্রার্থী জোরের সঙ্গে বলেছিলেন, ১৫ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করে তাঁরা আবার জমায়েতের ডাক দেবেন। সমস্যা এখানেও রয়েছে। যেটা কিছুক্ষণ আগেই লিখলাম। প্রতিবাদকারীদের মধ্যেও এখন দুটো ভাগ হয়ে গিয়েছে অনেকদিন। সরকারপক্ষ ও বিরোধীপক্ষের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে।
সব থেকে বড় প্রশ্ন অবশ্য অন্য। শিক্ষা দুর্নীতির প্রভাব ভোটে আদৌ কতটা পড়বে? শুধু বাংলা নয়, দেশের অধিকাংশ রাজ্যেই একটা জিনিস স্পষ্ট। প্রচুর মানুষ এতটাই দুর্নীতিতে অভ্যস্ত, নিজেরাও জড়িয়ে গিয়েছেন, খুব সাধারণভাবে দেখছেন ব্যাপারটা। সব পার্টিতেই নীতিভ্রষ্টদের ভিড়। কার দ্বারস্থ হবেন? এসবের মাঝেই চোখে পড়ে কিছু তরুণের নাছোড় মনোভাব। গান্ধিমূর্তির নীচে যাঁরা আজও বসছেন, তাঁদের বসার মেয়াদ এখন দশটা থেকে পাঁচটা। বসার ত্রিপলগুলো ওঁরা রেখে যাচ্ছেন ময়দানের এক তাঁবুতে। কোচবিহার, মালদা, নদিয়ার ছেলেরা নরেন্দ্রপুরের কাছে একটা বাড়িভাড়া করেছেন। রান্নাবান্না করছেন। তারপর খেয়ে আসছেন ধর্নায় হাজিরা দিতে। অনেকেই প্রাইভেট টিউশনি করে সংসার চালান। এখন মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের জন্য টিউশনি বন্ধ। সেই সুযোগে অনেকে ঘুরে যাচ্ছেন কলকাতায়, ধর্না মঞ্চে। কত ঘাম, কত পরিশ্রম, যন্ত্রণা মিশে রয়েছে ঘোরাঘুরির মধ্যে, অধিকাংশ ভোটারই জানেন না। জানার আগ্রহ নেই তেমন।
শহিদ মিনারের পাশে যেখানে মঞ্চ বানিয়ে ডিএ আদায়ের প্রতিবাদ চলছে, সেখানে গান-প্রতিবাদ চলছে। অনেক গোছানো। মঞ্চের চারপাশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ব্যঙ্গ করে একাধিক কার্টুন। সরকারি কর্মীদের টাকা অবশ্যই বেকার চাকরিপ্রার্থীদের থেকে বেশি। এবং বিরোধী নেতারাও জানেন, ঠিক কোনখানে বেশি নজর দিলে ভোট বেশি পড়বে।
এখানেও চোখে পড়ে, সাধারণ মানুষের নির্মম ঔদাসীন্য। শহিদ মিনারের নীচে শীতের বহু মরশুমি ফুল। সামান্য দূরের ধর্মতলা বাসস্ট্যান্ড আজও সেই আদিম যুগে পড়ে। নোংরার চূড়ান্ত। বাস রাখার কোনও সুশৃঙ্খল নেই। শহরের প্রাণকেন্দ্র এতদিন ধরে এত নোংরা থাকে কী করে? শুধু শহিদ মিনারের বাহারি সব বেঞ্চ। সেখানে নানা বয়সি নরনারী আড্ডারত। বক্তৃতা, গানে তাঁদের আগ্রহ নেই।
কলকাতার মানুষ এত স্থির, উদাসীন হয়ে যায় কী করে? কয়েক ফুট দূরে চলছে প্রতিবাদ, তাতে প্রেমের সংলাপে ক্লান্তি নেই। বরং সরকারি কর্মীদের ঢিলেঢালা মনোভাব ও কাজে ফাঁকি নিয়ে ব্যঙ্গ শুনলাম ওই ভিড়ের মধ্যে। শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে সকাল দুপুর রাস্তার ধারে পড়ে থাকা তরুণ প্রজন্মকে অবশ্য এই ব্যঙ্গ শুনতে হচ্ছে না। শুধু আগের মতো আর দৃষ্টি আকর্ষণ করে না।
ছটফটে কাঠবেড়ালিগুলোদেরই কৌতূহল ও যাতায়াত বেশি বঞ্চিত প্রতিবাদীদের ঘিরে। বেচারারা শুধু বোঝে না, তাদের জন্য সহানুভূতির খাবার আনা মানুষের ঢল কেন এত কমে চলে দিনকে দিন। কেন ভাগাভাগি হয়ে যায় ‘বন্ধু’দের বসার জায়গা। কেন চেনা কিছু মুখ, চেনা কিছু স্পর্শ মাঝে মাঝে হারিয়ে যায়। আবার আসে। আবার উধাও হয়ে যায়। কেউ আবার একদিন থেকে কোনওদিন ফেরে না আর। পাশের মেহগনি, আম, কৃষ্ণচূড়া, শিমুল ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। সবিস্ময় তাকিয়ে সময় চলে যায়।
পাথরের গান্ধিমূর্তিও নিশ্চয়ই ওই বিস্ময় নিয়েই শিশির ও রোদ মেখে দাঁড়িয়ে থাকেন। মনে মনে কী বলতে পারেন তিনি?
একটু চোখ খুলে ভাই, একটু চোখ খুলে! ভোট যে আসছে!