Thursday, May 16, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়ওঁরা যে কখন ক্লাস করান বুঝি না

ওঁরা যে কখন ক্লাস করান বুঝি না

শুভঙ্কর চক্রবর্তী

দু’দিন আগের কথা দিয়েই শুরু করি। তখন বেলা ১২-১২.৩০ হবে। কলা ভবনের সামনে চায়ের দোকানে জমে উঠেছে গোল টুল বৈঠক। গুনে দেখলাম চারজন শিক্ষক, দূরশিক্ষা বিভাগের এক আধিকারিক আর দুজন শিক্ষাকর্মী বসেছেন। কেন মুখ্যমন্ত্রী শিলিগুড়িতে র‍্যালি বাতিল করে তড়িঘড়ি কলকাতায় চলে গেলেন তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ঘণ্টা দেড়েক বাদে সেই রাস্তায় ফিরতে গিয়ে দেখলাম বৈঠক তখনও চলছে। সেখানে নতুন করে আরও কয়েকজন শিক্ষক যোগ দিয়েছেন।

এবার দেখলাম বিষয় পরিবর্তন হয়েছে৷ কোন শিক্ষক কাকে কীভাবে টাইট দিয়েছেন, কোন আধিকারিক কার সঙ্গে কার বাড়িতে গোপন বৈঠক করছেন, কে কার সঙ্গে বিরিয়ানি খেতে গিয়েছিলেন ইত্যাদি নিয়ে কথা হচ্ছে। দোকানদারকে চুপিচুপি জিজ্ঞাসা করলাম, কতক্ষণ চলবে? বললেন, ‘সারারাত, দোকান খোলা রাখলে সারারাতই চলবে। ওরা কখন যে ক্লাস করান, কখন যে কাজ করেন বুঝি না। আমার ছেলেমেয়েদের তো এই ইউনিভার্সিটিতে পড়াব না।’

এটা উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব চেনা ছবি। বর্তমানে সেই ছবিটা আরও প্রাণবন্ত হয়েছে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘প্রশাসন’ বলে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। যে যার খেয়ালখুশিমতো চলছেন। বর্তমানে পড়াশোনা বাদে ক্যাম্পাসে বাকি সবকিছুই হচ্ছে। আসলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসটা পুতুলনাচের তাঁবুর মতো হয়ে গিয়েছে।

পুতুলনাচের আমরা যে পুতুলগুলি দেখি সেগুলো সাধারণত চার ধরনের হয়, তারের পুতুল, লাঠিপুতুল, বেণীপুতুল ও ছায়াপুতুল। তারের পুতুল সূক্ষ্ম তার বা সুতার সাহায্যে এবং লাঠিপুতুল লম্বা সরু লাঠির সাহায্যে নাচানো হয়। আর দুই বা ততোধিক পুতুল যখন একসঙ্গে বেঁধে হাত দিয়ে নাচানো হয় তখন তাকে বলে বেণীপুতুল। যে কোনও গল্প বা কাহিনী অবলম্বনে পুতুলগুলিকে দর্শকদের সামনে উপস্থিত করা হয়। চরিত্র অনুসারে নানাবিধ উপকরণ সংযোজন করে পরিচালক পুতুলের অভিনয়শৈলী তুলে ধরেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের একাংশ তারের পুতুল হলে, আধিকারিকদের একাংশ লাঠিপুতুল আর অস্থায়ী শিক্ষক বা শিক্ষাকর্মীদের বেণীপুতুল বলাই যায়। হাতেগোনা কয়েকজনকে বাদ দিলে আসলে নাচছে সবাই। কারও সুতো রাজ্যপালের হাতে, কারও লাঠি তৃণমূলের পার্টি অফিসে। কাউকে আবার হাতে বেঁধে নাচাচ্ছে আরএসএস। ফলে যা হবার হয়েছে। শিক্ষা, গবেষণা রসাতলে গিয়েছে।

উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স ৬২ বছর। রাজ্যের পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয়টি। অথচ সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুরবস্থা নিয়ে কোনও হেলদোল নেই রাজ্য সরকারের। মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো গত এক বছরে চারবার উপাচার্য বদল হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। কী কারণে বদল তা একমাত্র রাজ্যপালই জানেন।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে কোনও গোপন উদ্দেশ্য পূরণ করতে না পারাতেই একজনকে সরিয়ে অন্যজনকে বসিয়েছেন সিভি আনন্দ বোস। তা না হলে শিক্ষাবিদদের সরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা সম্পর্কে দূরদূরান্ত পর্যন্ত কোনও সম্পর্ক বা জ্ঞান না থাকা একজন অবসরপ্রাপ্ত আইপিএসকে উপাচার্য করতেন না তিনি।

সেই আইপিএস সিএম রবীন্দ্রন চেয়ারে বসে স্বীকার করে নিয়েছেন তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তাহলে কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয় চলবে? একদিন সকালে দুম করে রবীন্দ্রন একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়ে দিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সংক্রান্ত কাজকর্ম দেখবেন ডিন, প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালনা করবেন ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এবং পরীক্ষার বিষয়গুলো দেখবেন পরীক্ষা নিয়ামক। বিজ্ঞপ্তিতে যা বলা হয়েছে  আইন ও নিয়ম অনুসারে সেটাই হওয়ার কথা এবং সেভাবেই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ হয়।

তাহলে আলাদা করে বিজ্ঞপ্তি কেন?  কারণ, বিজ্ঞপ্তি দিয়ে রবীন্দ্রন জানিয়ে দিলেন, তিনি নিজে কোনও ফাইল দেখবেন না। সব কাজ করবেন আধিকারিকরা। অর্থাৎ তিনি দায়িত্বহীন ক্ষমতা ভোগ করবেন। আর আধিকারিকদের হাতে থাকবে ক্ষমতাহীন দায়িত্ব। আধিকারিকদের একাংশ সেটা না বুঝেই ভাবলেন, ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য কিছুই বোঝেন না। অতএব তাঁরাই এবার থেকে রাজা। তাঁদের কথাই বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষকথা।

এতদিন অস্থায়ী শিক্ষাকর্মীরাও জো-হুজুর করছিলেন। ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারকে মাথায় তুলে রেখেছিলেন। যেই বুঝলেন তাঁদের বেতন বৃদ্ধি হচ্ছে না এবং কলকাঠি নাড়া হচ্ছে সেই রেজিস্ট্রারের দপ্তর থেকেই তখন তাঁরা শুরু করলেন আন্দোলন। এতদিন ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য বা রেজিস্ট্রারের কথাই ছিল শেষকথা। মোটামুটি সবাই তাঁদের সুরেই সুর মেলাচ্ছিলেন। প্রথমবার শিক্ষাকর্মীদের আন্দোলনের মুখে পড়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে পালিয়েছেন দুজনেই।

২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত রবীন্দ্রন। দপ্তরে আসছেন না ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার স্বপনকুমার রক্ষিত। ফলে প্রশাসনিক কাজ বন্ধ। কার্যত স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে গবেষণার কাজকর্ম। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ডিনের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২১ ফেব্রুয়ারি। যার দরুন শিক্ষা সংক্রান্ত কাজকর্ম থমকে গিয়েছে।

সমস্যা আরও জটিল হবে ১৯ মার্চের পরে। স্থায়ী পদে নিয়োগ না হওয়ায় ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ও ফিন্যান্স অফিসার দিয়ে এতদিন কাজ চলছিল। দুজনেরই মেয়াদ শেষ হবে ১৯ মার্চ। তারপর কাজ চালাবে কে সেই প্রশ্নের উত্তর আপাতত অধরা। আবার এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই ছয় মাসের মেয়াদ ফুরোবে রবীন্দ্রনেরও। সবমিলিয়ে এই মুহূর্তে অথই জলে উত্তরবঙ্গের সব থেকে পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়টি।

না, এখানেই সমস্যা শেষ নয়। একটি বড় আইনি জটিলতা ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার বা ফিন্যান্স অফিসারকে উপাচার্য নিয়োগ করলেও সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসমিতিতে অনুমোদিত হতে হয়। প্রায় আট মাস বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসমিতির বৈঠক হয়নি। অর্থাৎ অনুমোদন ছাড়াই গত ছয় মাস ধরে কাজ করছেন ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ও ফিন্যান্স অফিসার। এই সময়কালে তাঁরা যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বা বাস্তবায়ন করেছেন সেগুলির কি আইনি বৈধতা থাকবে? এই প্রশ্নই এখন বড় হয়ে উঠেছে। অনুমোদনহীন আধিকারিকদের সিদ্ধান্ত অবৈধ হলে সব হিসেব নতুন করে কষতে হবে।

স্বাধীনতার পর রাজ্যের শিক্ষায় এমন পরিস্থিতি হয়নি। উচ্চশিক্ষার রাশ চলে গিয়েছে রাজভবনে। বল্গাহীন ক্ষমতা পাইয়ে দেওয়া হয়েছে রাজ্যপালকে। আর সবাইকে বিস্মিত করে অদ্ভুতভাবে নির্লিপ্ত রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী। সব জেনেবুঝেও তিনি দিব্যি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছেন। ব্যাংও একসময় শীতঘুম থেকে জেগে ওঠে, কিন্তু উচ্চশিক্ষা সর্বনাশের দোরগোড়ায় চলে এলেও রাজ্যের ঘুম ভাঙছে না। অবশ্য ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে ব্রাত্য বসু জেগে ঘুমোচ্ছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অচলাবস্থার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে কলেজগুলোতে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পাঁচ জেলার ৪৯টি কলেজ আছে। সদ্য প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যাচ্ছে স্নাতক স্তরে ৯০ শতাংশের বেশি ছাত্রছাত্রী ‘ফেল’ করেছে। তা নিয়ে অবশ্য কারও মাথাব্যথা নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আধিকারিক, শিক্ষাকর্মীরা আড়াআড়িভাবে দুই দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। একদল রাজ্যপাল বা বিজেপি বা আরএসএস-এর পক্ষে, আর একদল রাজ্য সরকার বা তৃণমূলের সমর্থনে ঘোঁট পাকাচ্ছে। শিক্ষাকে সামনে রেখে প্রত্যক্ষ রাজনীতি চলছে।

ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা হয়েছে। জেলায় জেলায় এলাকা দখলের লড়াইও শুরু হয়ে গিয়েছে। সেই লড়াইয়ে বোমা, বন্দুক আছে। সেখানে প্রতিদিন  রক্তপাত ঘটছে, খুন হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও ক্ষমতা দখলের লড়াই চলছে। শিক্ষকদের একটা বড় অংশ সেই লড়াইয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আর তারমাঝে পরে খুন হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ।  ভবিষ্যৎ খুনের দায় কি রাজনৈতিক হত্যার চেয়ে কোনও অংশে কম?

‘দুই উপমা’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে, সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে।’ আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটা বড় অংশকে ক্ষমতা আর লোভের শৈবাল বেঁধে ফেলেছে। তাই তাঁরা প্রতিবাদের ভাষা হারিয়েছেন। পথ দেখাতে পারছেন না। বাংলার শিক্ষায় প্রকৃত অর্থেই মাৎস্যন্যায় এসেছে।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

রাজনীতিবিদ হওয়ার স্বপ্ন কবে দেখবে নবীন প্রজন্ম

0
  অনুপ দত্ত বীরভূমের উত্তর লাভপুরের শীতলগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র রিক বাগদী বোকা হতে চায়। কারণ বোকা হলে ও কাউকে ঠকাবে না! বোকা হওয়া! সে...

শিল্পকলার অপব্যবহার নিয়ে কিছু প্রশ্ন

0
  পার্থ চৌধুরী আমাদের ছেলেবেলায় শিলিগুড়িতে নামগানের রমরমা ছিল উল্লেখ করার মতো। কোনও কোনও ঘুম না আসা মধ্যরাতে শুনতে পেতাম, বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে কীর্তনের সুর।...

শ্রীবিহীন নীতি ভাঙা ‘কন্যাশ্রী’

0
  ইন্দ্রাণী সেনগুপ্ত কলেজ থেকে ফিরলাম। সকাল দশটা থেকে একটা পর্যন্ত আমার তিনটে ক্লাস ছিল, প্রত্যেকটি এক ঘণ্টার। আমাদের এক-একটা ক্লাসে এক ঘণ্টার লেকচারের সময়সীমা।...

Himanta Biswa Sarma | ‘বিজেপি ৪০০ আসনে জিতলেই পাক অধিকৃত কাশ্মীর ভারতের’, দাবি হিমন্তের

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: বিক্ষোভের আগুনে পুড়ছে পাক অধিকৃত কাশ্মীর। পাকিস্তানের সরকারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছেন সেখানের বাসিন্দারা। এবার লোকসভা ভোটের প্রচারে বিজেপি নেতা তথা...

Weather Report | ফের রাজ্যে বাড়ছে তাপমাত্রা, উত্তরের ৫ জেলায় হালকা বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: তীব্র তাপপ্রবাহের পর বৃষ্টিতে রাজ্যের তাপমাত্রা নেমেছিল কিছুটা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল উত্তর থেকে দক্ষিণ। তবে বৃষ্টি উধাও হতেই ফের বঙ্গে...

Most Popular