- রন্তিদেব সেনগুপ্ত
দিলীপ ঘোষকে এবার মেদিনীপুরে লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী করেনি বিজেপি। যেদিন ঘোষণা করা হল, দিলীপ মেদিনীপুরের প্রার্থী নন, সেদিনই রাজ্য বিজেপির এক নেতা একান্ত কথাবার্তায় খেদোক্তি করেছিলেন, দিলীপদার জেতাটা যখন একশো শতাংশ নিশ্চিত ছিল, তখন দিলীপদাকে পঞ্চাশ-পঞ্চাশ লড়াইয়ের মুখে ফেলে দেওয়া হল। দিলীপ অবশ্য প্রকাশ্যে বলছেন, তিনি এই নতুন কেন্দ্রেও জিতবেন। কিন্তু যাঁরা বিজেপির ভিতরের খবর রাখেন, তাঁরা জানেন, দিলীপের এটা মুখের কথা। মনের কথা নয়। কেন্দ্র পরিবর্তনে তিনি যে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ সেটা দিলীপ দলে এবং আরএসএসের ভিতরেও খোলাখুলিই জানিয়ে দিয়েছেন। বিজেপি এবং আরএসএসের একটি বড় অংশও এই কেন্দ্র বদলটি মেনে নিতে পারছে না।
দিলীপের সঙ্গে এরকম আচরণ করল কেন বিজেপি নেতৃত্ব? তার একটি ব্যাখ্যা বিজেপিরই একটি মহল থেকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কুকথা বলার অপরাধেই নাকি দিলীপের এই হাল। বিজেপির অন্দরমহলেই সকলে অবশ্য বলাবলি করছে, একা দিলীপ ঘোষ নন। কুকথা বিজেপির অনেক নেতাই বলেন। এমনকি, বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, যাঁর সঙ্গে দিল্লির নেতাদের সর্বাধিক দহরম মহরম, কুকথার প্রতিযোগিতায় তিনি কিছু কম যান না। এইসব নেতার বিরুদ্ধে তেমন কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি কেন? শুধু দিলীপ কেন আসামি?
এখানেই রহস্য। দিলীপ তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে বরাবরই বিতর্কিত। রাজনৈতিক জীবনে পা রাখার পরই তাঁর একের পর এক মন্তব্য তাঁকে ক্রমশ বিতর্কিত করে তুলেছে। কখনও তার জন্য দিলীপ মানুষের কাছে ঘৃণার পাত্র হয়েছেন, কখনও বা সকলের হাসির উদ্রেক করেছেন। তবে এইসব মন্তব্যের জন্য দিলীপ কোথাও কখনও দুঃখ প্রকাশ করেছেন বা ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন–এমন শোনা যায়নি। দিলীপ রয়েছেন দিলীপেই।
এর পাশাপাশি একথাও ঠিক, দলের রাজ্য সভাপতি হয়ে আসার পর দিলীপ বিজেপিকে অনেকটাই সচল করে তুলতে পেরেছিলেন। দলীয় কর্মীদেরও উজ্জীবিত করতে পেরেছিলেন এবং দিলীপের সভাপতিত্বের সময়ই বিজেপি এই রাজ্য থেকে আঠারোটি লোকসভা আসনে জয়ী হয়েছিল। সেই দিলীপের এই হাল হল কেন? প্রথম তালিকায় দিলীপের নামই ছিল না। দিলীপের মতো নেতার পক্ষে এটি যথেষ্ট অবমাননাকর। বিজেপির অন্দরমহলে অনেকেই বলছেন, এটা আসলে দিলীপের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।
দলে দিলীপের কোণঠাসা হওয়া শুরু ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের পরেই। নির্বাচনের পরে শুভেন্দু অধিকারীর তৃণমূল ত্যাগ করে বিজেপিতে প্রবেশ। তার কিছুদিন পরেই দিলীপকে সরিয়ে সুকান্ত মজুমদারকে দলের রাজ্য সভাপতি করা। লক্ষ করে দেখবেন, এই সময় থেকেই সংগঠনে দিলীপ কোণঠাসা হতে থাকেন। দলের কোনও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে দিলীপকে বাদ রাখা শুরু হয়। দিলীপ নিজেই হয়ে ওঠেন ওয়ান ম্যান আর্মি। এই সময় থেকেই দিলীপ এমন কিছু মন্তব্যও করেন যা কার্যত দলের নেতাদেরই কাঠগড়ায় তোলে। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গেও এই সময় থেকেই দিলীপের দূরত্ব বাড়তে থাকে। এমনকি, প্রধানমন্ত্রীর সভাতেও উপস্থিত থাকতে অনাগ্রহ দেখান দিলীপ।
আসলে ওই নির্বাচনের পরই রাজ্য বিজেপির অভ্যন্তরে ক্ষমতা দখলের লড়াইটি শুরু হয়েছিল। উচ্চাকাঙ্ক্ষী শুভেন্দু বিজেপিতে ঢুকে বিজেপির ত্রাতার ভাবমূর্তি তৈরি করে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের, বিশেষ করে অমিত শা এবং নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন অচিরেই। এই প্রতিযোগিতায় তাঁর সঙ্গে বিজেপির পুরোনো নেতারা এঁটে উঠতে পারেননি। এই মুহূর্তে এই রাজ্যে মোদি-শা’র সর্বাধিক ঘনিষ্ঠ নেতা এই শুভেন্দুই।
বিজেপির ভিতর একটি বড় অংশই মনে করে, দলের ভিতর অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেতাই দিলীপের জনপ্রিয়তা সহ্য করতে পারেননি। তাঁরা মনে করেছেন, দিলীপকে দলে অকেজো করে না দিতে পারলে দলের সর্বময় কর্তৃত্ব দখল করা যাবে না। এই নেতারাই নানাবিধ উপায়ে দিলীপ সম্পর্কে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মনে বিরক্তির জন্ম দিয়ে, দলের ভিতর ‘দিলীপ খতম’ অভিযান চালিয়ে গিয়েছেন। বিজেপিরই এক নেতা বলেছিলেন, ‘দিলীপ সম্পর্কে দিনের পর দিন একদল নেতা নাড্ডা এবং শা’র কাছে নানারকম রিপোর্ট পাঠিয়ে গিয়েছেন।’ তারই ফলশ্রুতি মেদিনীপুর থেকে দিলীপকে সরানো।
আর দিলীপ? বিজেপির ওই নেতাই বলেছিলেন, ‘দিলীপদার সবথেকে বড় ভুল ঔদ্ধত্য। দিলীপদা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকেও অনেক সময় গুরুত্ব না দিয়ে নিজের মতো চলতে চেয়েছেন। এই যে এত অভিযোগ তাঁর সম্পর্কে দিল্লিতে জানানো হচ্ছে, এটা দিলীপদা সব জানতেন। জেনেও ধরে নিয়েছিলেন, তাঁর টিকি ছোঁয়ার সাহস নেতৃত্বের হবে না।’
বিজেপি নেতৃত্ব যতই সাফাই গান না কেন, দিলীপের কেন্দ্র পরিবর্তন আসলে রাজ্য বিজেপির গোষ্ঠী লড়াইয়ের নির্লজ্জ প্রকাশ। রাজ্য বিজেপিতে এখন তিনটি গোষ্ঠী। একটি শুভেন্দুর, একটি সুকান্তর এবং অপরটির দিলীপের। এর বাইরেও রাহুল সিনহার একটি গোষ্ঠী রয়েছে। যদিও রাহুল গোষ্ঠীর কোমরের জোর আগের মতো আর নেই। কোনও গোষ্ঠীর গোষ্ঠীপতির সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতা করার অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে, তাঁরাই জানেন, একটি গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর প্রতি কী বিদ্বেষ এবং আক্রোশ পোষণ করে। এমনকি এরা রাজনৈতিক কর্মসূচিও নেয় যত না তৃণমূল বিরোধিতার কারণে, তার চেয়ে বেশি পরস্পরকে টেক্কা দিতে। এই গোষ্ঠীপতিদের ভিতর আবার এই মুহূর্তে মোদি-শা’র কৃপায় দলীয় সংগঠনে শুভেন্দুর দাপট বেশি। দলের বিধায়কদের গরিষ্ঠাংশই শুভেন্দু অনুগামী। দলে এই অভিযোগও আছে, দলের পুরোনো নেতাদের নিষ্ক্রিয় করে শুভেন্দু অনুগামীদের দায়িত্বে বসানো হয়েছে।
সুকান্ত খাতায়-কলমে সভাপতি হলেও এবার লোকসভা ভোটে প্রার্থী বাছাইয়েও শুভেন্দুর মতামতই গুরুত্ব পেয়েছে। এক বিজেপি নেতা তো টেলিফোনে আমাকে বলেই ফেললেন, ‘দলের ভিতর অনেকেই অপেক্ষা করছে, একবার যদি আসন কমে যায় তবে শুভেন্দুকে মাটিতে পেড়ে ফেলবে তারা।’ তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘কে অপেক্ষা করছেন? দিলীপ ঘোষ?’ তাঁর উত্তর, ‘শুধু দিলীপ ঘোষ নন। আরও দুজন। যা বোঝার বুঝে নিন।’ দলের ভিতর মল্লযুদ্ধের ক্ষেত্রটি পুরোপুরিই প্রস্তুত।
যা বুঝতে পারছি, ভোটটা শুধু তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিজেপির লড়াই নয়। শুভেন্দু বনাম দিলীপ বনাম সুকান্ত বনাম রাহুলের গেরিলা যুদ্ধও।