নয়াদিল্লি: বিতর্কিত দিল্লি অর্ডিন্যান্স ইস্যুতে কংগ্রেস-আপ ও বিজেপির ‘ত্রিমুখী’ সংঘাত যখন তুঙ্গে, সংশ্লিষ্ট অর্ডিন্যান্স নিয়ে সমর্থনে কংগ্রেসের ‘মৌনতা’ ও আপ-র ‘ক্ষোভ’ নিয়ে যখন উদ্বিগ্ন বিরোধী ফ্রন্ট, সেই মুহূর্তে বুধবার বিরোধী শিবিরের অস্বস্তি কয়েক গুণ বাড়িয়ে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বা ইউনিফর্ম সিভিল কোড ইস্যুতে কেন্দ্রীয় শাসক দল বিজেপিকে নৈতিক সমর্থন দিল অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আপ আদমি পার্টি৷ মঙ্গলবার ভোপালে দলীয় অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সারা দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি লাগু করার পক্ষে জোরালো সওয়াল করার পরে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিল কংগ্রেস সহ বেশ কয়েকটি বিরোধী দল৷
এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে কেজরিওয়ালের দল বুধবার জানিয়ে দিয়েছে, তারা নীতিগত ভাবে সমর্থন করছে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি৷ দলের তরফে এই মর্মে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে আপের কেন্দ্রীয় নেতা সন্দীপ পাঠক বলেন, ‘সরকার যদি সারা দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রয়োগ করতে চায় তাহলে আমাদের নীতিগত সমর্থন থাকবে৷ তবে এই বিধি প্রয়োগের আগে সমাজের সর্বস্তরে সবিস্তারে আলোচনা জরুরি৷’ আপ-র এই ঘোষণার পর এদিন আরও একবার বড়সড় প্রশ্নচিহ্নের সামনে পড়েছে বিরোধী ঐক্য, এমনটাই মনে করছে রাজনৈতিক মহলের একাংশ৷ অবশ্য এই বিতর্কে আপ-র কেন্দ্রীয় নেতা সঞ্জয় বসুর ব্যাখ্যা অন্যরকম৷ তাঁর দাবি, ‘আমাদের দল নীতিগত ভাবে অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে সমর্থন জানাচ্ছে৷ একইসঙ্গে দলের তরফে জানানো হয়েছে এই বিধি নিয়ে সবার সঙ্গে আগে আলোচনা করতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে৷ সরকারের প্রস্তাবিত অভিন্ন দেওয়ানি বিধিতে কী থাকবে তা আগে জানাতে হবে৷ আমাদের নীতিগত সমর্থনের অর্থ এই নয় যে মোদি সরকার যে শর্তই আরোপ করবে তাতে সমর্থন দেবো আমরা৷’
বস্তুত, প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সারা দেশে সংগঠিত হওয়া সাধারণ নির্বাচনের সময়ে একটি স্পর্শকাতর ইস্যুকে হাতিয়ার করাই বিজেপির প্রথাগত কৌশল৷ ২০১৯-র ভোটে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা সিএএ, রাম মন্দির ইস্যুকে নির্বাচনী হাতিয়ার করেছিল গেরুয়া শিবির৷ তার আগে ২০১৪ সালে বিজেপির অন্যতম প্রধান নির্বাচনী ইস্যু ছিল তিন তালাক প্রথার বিলুপ্তি এবং বিদেশ থেকে কালো টাকা ফেরানো৷ সেই সূত্রে আগামী বছরে ভোটের জমি তৈরি করতে গিয়ে এবার বিজেপি যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকেই তাদের প্রধান হাতিয়ার করার কথা ভাবছে, তার আভাস মিলেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কথাতেই৷ মঙ্গলবার তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, দেশের অগ্রগতির জন্যই অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রবর্তন প্রয়োজন৷ তাঁর প্রশ্ন ছিল, ‘একই পরিবারের সদস্যদের জন্য ভিন্ন আইন থাকে কী করে? এই অসামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থান মেটানোর জন্য অভিন্ন দেওয়ানি বিধি লাগু করা প্রয়োজন।’
মঙ্গলবারই প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেছে বিরোধী শিবির৷ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক(সংগঠন) কে সি বেণুগোপাল সরাসরি অভিযোগ করেছেন যে, ‘মণিপুর, বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধির মত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলি থেকে দেশবাসীর নজর ঘোরানোর জন্যই প্রধানমন্ত্রী অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছেন৷’ একই সুরে প্রধানমন্ত্রীকে নিশানা করেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভা দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন৷ তাঁর অভিযোগ, ‘যখন আপনি (মোদি) বেকারত্ব মেটাতে ব্যর্থ, যখন আপনি মূল্যবৃদ্ধি কমাতে অক্ষম, যখন সব প্রতিশ্রুতি পালনে আপনি অসমর্থ, যখন দেশের সামাজিক পরিকাঠামোকে ধ্বংস করতে উদ্যত আপনি, তখন ২০২৪-র আগে বিভাজনের রাজনীতি করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন৷’ মঙ্গলবার অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের পরেই গভীর রাতে জরুরি বৈঠকে বসে মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড৷ দীর্ঘ আলোচনার পরে তাঁরা জানিয়েছে, একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একটি খসড়া তৈরি করা হবে। সেখানে শারিয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করা থাকবে। কেন এটা প্রয়োজন সেটা বলা হবে। ল কমিশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করে এই খসড়া জমা দেওয়ার জন্য সময় চাওয়া হবে।
এই আবহে বুধবার আম আদমি পার্টির তরফে যেভাবে অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে সমর্থন করা হয়েছে সেই বিষয়টিকে মোটেই ভালোভাবে নিচ্ছে না বিরোধী শিবির৷ আগ বাড়িয়ে যেভাবে আপ এই স্পর্শকাতর ইস্যুতে তাদের মনোভাব ব্যক্ত করেছে বিরোধী ঐক্যের নিরিখে তা একেবারেই কাঙ্খিত নয় বলে দাবি জানানো হয়েছে কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে৷ এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বর্ষীয়ান কংগ্রেস সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি দল৷ বিষয়টি আলোচনার স্তরে আছে৷ দলীয় আবহ দেখে এটুকু বলতে পারি দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার পরিপন্থী কোনও পদক্ষেপ করবে না কংগ্রেস৷ অন্য কোনও দল কী সিদ্ধান্ত নেবে সেটা তাদের বিষয়৷ কিন্তু বিরোধী ঐক্য এবং ইস্যুটির সংবেদনশীলতা মাথায় রাখা উচিত৷’ একই সুর শোনা গিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ দোলা সেনের গলায়৷ তাঁর কটাক্ষ, ‘প্রধানমন্ত্রীর আর কাজ কী? মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়। প্রতিবার লোকসভা ভোটের আগে তিনি স্পর্শকাতর ইস্যু খুঁজে নিয়ে আসেন আর তা নিয়ে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করা হয়৷ পাঁচ বছর আগে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন সিএএ চালু করার কথা বলা হয়৷ এখনও তা বিশ বাঁও জলে৷’ দলের সম্ভাব্য অবস্থান ব্যাখা করতে গিয়ে তৃণমূল সাংসদ দোলা সেনের দাবি, ‘আমাদের দল এখনও এই ইস্যুতে কিছু ভাবেনি বলেই জানি৷ আমার মনে হয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে অন্যান্য সমমনোভাবাপন্ন দলগুলির সঙ্গে নিশ্চয়ই আলোচনা করা হবে৷’ এই আবহে বিশেষজ্ঞ মহলের দাবি, আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে আসন্ন ১৪ জুলাইয়ে সিমলার বিরোধী বৈঠক, যেখানে একের বিরুদ্ধে এক ফর্মুলা ও দিল্লি অর্ডিনান্সের পাশাপাশি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়েও নিজেদের অবস্থান স্থির করতে পারে বিরোধী শিবির৷