সাগর বাগচী, শিলিগুড়ি: ছোট্ট ঘরটিতে প্রবেশ করতে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য থমকে যেতে হয়। হাতের ডানদিকে, টেবিলের ওপর রাখা সেগুন কাঠের টুকরো, স্কেল, পেন্সিল, হাতুড়ি, ছেনি। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাটিং মেশিন ও ড্রিল মেশিন, মাঝারি আকারের লগ। নীল রং করা দেওয়ালে হেলান দিয়ে রাখা বিভিন্ন আকারের বেশ কয়েকটি এসরাজ। রবিবার দুপুরে শিলিগুড়ির(Siliguri) ২২ নম্বর ওয়ার্ডের রবীন্দ্রনগরের নেতাজিপল্লির বাসিন্দা অভ্রদীপ পোদ্দার নিজের সেই ঘরের মেঝেতে বসে হাতে ছেনি, হাতুড়ি নিয়ে একটি কাঠের টুকরোকে নির্দিষ্ট আকার দিচ্ছিলেন।
কিছুক্ষণ কাজ করার পর হাতুড়ি, ছেনি পাশে রেখে অভ্রদীপ একটি এসরাজ(Esraj) হাতে তুলে নিয়ে বলেন, ‘এসরাজের তালিম নিতে নিতে এটি বানানো শিখে গিয়েছি। যার পুরোটাই অনলাইনে। কিন্তু উত্তরবঙ্গ বা শিলিগুড়িতে এসরাজের কোনও কদর নেই।’ পঞ্জাব, দিল্লি, রাজস্থানের মতো বিভিন্ন জায়গায় অভ্রদীপের তৈরি এসরাজ সরবরাহ করা হয়েছে। আমেরিকা, ইংল্যান্ড থেকে অনেকে তাঁর কাছে এসরাজ চেয়ে ফোন করছেন। কিন্তু এই অঞ্চলের মানুষের কাছে ভারতীয় ঘরানার হাজার বছরের পুরোনো ঐতিহ্য এই বাদ্যযন্ত্রের যে কদর নেই সেই আক্ষেপ করছিলেন অভ্রদীপ। এই এলাকায় কেউ শিখতেও চান না।
শিলিগুড়ি কলেজের ভূগোল বিভাগের প্রাক্তনী ওই তরুণ বর্তমানে মাল কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের অস্থায়ী ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে কর্মরত। ফাঁকা সময় বের করে এসরাজের তালিম নেওয়ার পাশাপাশি তা তৈরিও করেন। উত্তরবঙ্গে সম্ভবত অভ্রদীপ একমাত্রই যিনি হাজার বছরের পুরোনো বাদ্যযন্ত্রটি তৈরি করতে জানেন।
কীভাবে এত জটিল একটি বাদ্যযন্ত্র তৈরি করা শিখলেন? অভ্রদীপের উত্তর, ‘প্রথমে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত ভবনের অধ্যক্ষ বুদ্ধদেব দাসের কাছে চার বছর এজরাজ বাজানোর তালিম নিয়েছিলাম। এরপর লকডাউনের সময় থেকে বাংলাদেশের খুলনার শিল্পী নিখিলকৃষ্ণ মজুমদারের কাছে অনলাইনে এসরাজ বাজানোর তালিম নিতে শুরু করি। তিনি বলেছিলেন কোনও যন্ত্র বাজানোর কৌশল আয়ত্ত করতে গেলে তা নিজে হাতে তৈরি করা জরুরি। আর সেখান থেকে শুরু। পুরোটা অনলাইনে নিখিলকৃষ্ণবাবুর কাছ থেকে শেখা।’ গত কয়েক বছরে অভ্রদীপ ২০টি এসরাজ তৈরি করেছেন। বর্তমানে বাদ্যযন্ত্রটি প্রায় ৩৫ হাজার টাকায় বাইরে বিক্রি হচ্ছে। তবে এটিকে তিনি পেশা হিসাবে নিতে চান না।
অভ্রদীপের কথায়, ‘এসরাজ সমস্ত বাদ্যন্ত্রের রানি। একটা বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ যাতে মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়, সেইমতো করে যন্ত্র তৈরি করা একপ্রকারের গবেষণা। এই কাজের মধ্যে স্বস্তি খুঁজে পাই। এসরাজ বানানোর অর্ডার পাচ্ছি। কিন্তু এতটা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। এই যন্ত্র একেবারে নিখুঁত হওয়া চাই।’ এসরাজের পাশাপাশি দোতারা ও সরোদ তৈরির কাজও করে চলেছেন এই তরুণ।