- দীপ সাহা
ঝড়ের পর চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। পাহাড়পুরজুড়ে কান্নার রোল। বিধ্বংসী ‘টর্নেডো’র তাণ্ডবে সর্বস্ব হারিয়ে দিগভ্রান্ত পরিবারগুলো। হঠাৎ লাল, নীল বাতির কনভয় ছুটিয়ে সেখানে পৌঁছোলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর পা পড়তেই চোখের জল মুছে সংবিত ফেরানোর চেষ্টা করল মৃত অণিমা বর্মনের পরিবার।
মাঝখানে বোধহয় ঘণ্টা নয়েকের ব্যবধান। প্রলয়ের পরপরই কলকাতায় মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, তিনি আসছেন। ওই রাতেই। কথা রাখলেন। বাগডোগরায় নেমে সোজা তাঁর কনভয় চলে গেল জলপাইগুড়িতে। সেখানে দুই মৃতের বাড়ি ঘুরে মেডিকেল কলেজে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, ‘দিদি’ পাশে আছেন। রাত ১২টা নাগাদ যখন তিনি পাঁচতলা থেকে নামলেন, তখন বাইরে ক্যামেরার ফ্ল্যাশের মুহুর্মুহু ঝলকানি। কথা না বাড়িয়ে সাংবাদিকদের তিনি শুধু জানিয়ে দিলেন, ভোটবিধি মেনেই প্রশাসন দুর্গতদের পাশে দাঁড়াবে। তাঁর নির্দেশ মেনে ঝড়ের গতিতে কাজ শুরু করে দিল প্রশাসন।
সেখান থেকে মুখ্যমন্ত্রী চলে যান ময়নাগুড়ির বার্নিশে। ঘড়ির কাঁটা তখন রাত ১টা ছুঁয়েছে। তিনি আসবেন বলে জেগে আছে গোটা গ্রাম। সরকারি কর্তাদের চোখেও ঘুম নেই। পুলিশ ও প্রশাসন একযোগে ময়দানে। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দুর্গতদের পাশে থাকার। মুখ্যমন্ত্রীকে দেখে তখন বোঝার উপায় নেই যে, দুপুরে কৃষ্ণনগরের সভা করে বিকেলে কলকাতায় ফিরে রাতের বিমানে আবার বাগডোগরায় এসেছেন তিনি। সেখান থেকে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার সড়কপথে এসে দুর্গতদের দোরে দোরে। চোখেমুখে এতটুকু ক্লান্তির ছাপ নেই।
শেষ কবে কোনও মুখ্যমন্ত্রী বিপর্যয়ের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে উত্তরবঙ্গে ছুটে এসেছেন, মনে করতে পারেন না কেউ। ১৯৯৩ সালের বন্যায় যখন ভেসে গিয়েছিল আলিপুরদুয়ার, তখন সেখানে পা মাড়াননি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। ঘটনার চারদিন পর জলপাইগুড়ির সার্কিট হাউসে প্রশাসনিক বৈঠক সেরে ফিরে গিয়েছিলেন কলকাতায়। এখানেই ফারাক গড়েছেন মমতা। ২০১১ সালে রাজ্যের ক্ষমতায় আসার বছরেই সেতু বিপর্যয় ঘটে দার্জিলিংয়ের বিজনবাড়িতে। মৃত্যু হয় ৩২ জনের। ঘটনার পরদিনই ছুটে এসেছিলেন তিনি। দার্জিলিং জেলা হাসপাতালে দেখা করেছিলেন আহতদের সঙ্গে। তখন ভোটের বালাই ছিল না। মমতা বোঝাতে চেয়েছিলেন, উত্তরবঙ্গ তাঁর পরমাত্মীয়।
বাম আমলে মুখ্যমন্ত্রীরা কেউ নিজে দাঁড়িয়ে কাজের তদারকি না করলেও অন্য মন্ত্রীরা করেছেন। যেমন ’৯৩-এর বন্যায় আলিপুরদুয়ারে এসে চুপিসারে কাজ করে গিয়েছেন তৎকালীন বিদ্যুৎমন্ত্রী শংকর সেন। কাকপক্ষী তো দূর, আমলারাও টের পাননি। এরকম উদাহরণ আরও বেশ কিছু আছে। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছেন মমতা। ময়নাগুড়ির বার্নিশ, ধর্মপুর, মাধবডাঙ্গা-২ গ্রাম পঞ্চায়েত ও আলিপুরদুয়ার-১ ব্লকের বেশ কিছু জায়গায় এখনও হাহাকার।
নির্বাচনি গেরোয় সরকার বিপর্যস্তদের ঘরবাড়ি তৈরি বা আর্থিক সাহায্য করতে না পারলেও প্রশাসন পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে বলে সন্তোষ প্রকাশ করছেন দুর্গতরা। খাবার থেকে শুরু করে ত্রাণ পৌঁছে দিতে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন আমলারা। তার ওপর মুখ্যমন্ত্রী ৬ এপ্রিল পর্যন্ত উত্তরবঙ্গে থাকবেন বলে মাস্টারস্ট্রোক খেলে দিয়েছেন। রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান ঘটনাস্থলের আশপাশে থাকবেন আর প্রশাসন ঢিলেঢালা কাজ করবে- তা হওয়ার জো নেই। সেই কারণে আধিকারিকদের তৎপরতা যে কয়েকগুণ বেড়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপালের আগমনকে ভালোভাবে নিলেও নেতাদের ভিড় কিন্তু মেনে নিতে পারছেন না সর্বস্ব হারানো মানুষগুলো। তৃণমূল হোক বা বিজেপি, ভোটবাজারে রাজনীতির ‘নাটক’ আর তাঁদের সইছে না। মুখ্যমন্ত্রী তা বুঝেছেন। তাই তৃণমূলের নেতাদের ঝড়দুর্গত এলাকায় বেশি ভিড় না করতে নির্দেশ দিয়েছেন। দুর্যোগের পরদিন রাজ্যপালের পাশাপাশি ময়নাগুড়িতে এসেছিলেন বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। বাগডোগরায় নামার পর থেকে বারংবার রাজ্য সরকারকে বিঁধেছেন তিনি। বিপর্যস্ত এলাকায় গিয়ে খুব রাজনৈতিক সুবিধা করে উঠতে পারেননি। তারপর বিজেপির আর বড় কোনও নেতা এলাকামুখো হচ্ছে না।
তার মধ্যে বিজেপির রাজ্যসভা সাংসদ নগেন রায় বার্নিশ কালীবাড়ির কায়েতপাড়ায় দুর্গতদের কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করে বিক্ষোভের মুখে পড়েছেন। তারপর তাঁকে ফিরে যেতে হয়েছে ওই এলাকা থেকে। মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে পুলিশ-প্রশাসন ভালো কাজ করছে বটে, কিন্তু খামতি একেবারে নেই, তা তো নয়। বরং বুধবারও মাধবডাঙ্গা-২’এর ক্ষতিগ্রস্তরা ত্রাণ নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ জানিয়েছেন। কিন্তু তা মিটেও গিয়েছে মুহূর্তে।
স্থানীয় নেতারা রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে দুর্গতদের পাশে থাকার বার্তা দিলেও আপাতত তাতে চিঁড়ে ভিজছে না। কারণ মাথার ওপর ছাদ হারানো অসহায় মানুষগুলোর এখন চাই দু’বেলা দু’মুঠো খাবার আর রাতে মাথা গোঁজার জন্য একখানা ত্রিপল। এই ভোট বাজারে নিয়মের গেরোয় যে তা প্রশাসন ছাড়া আর কারও পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়, তাও বুঝে গিয়েছেন চালচুলোহীন মানুষগুলো। তাই ভোটভাবনা থেকে শতযোজন দূরে থাকা মানুষগুলো ভরসা রাখছেন প্রশাসনের ওপরই।