- গৌতম সরকার
জিতবে কে? অমুক পার্টি আবার কে! জিতবে কারা? অমুক দাদা, তমুক দিদি আবার কারা! জিতবে কেন? লম্বা ফিরিস্তি হাজির থাকে ঠোঁটের আগায়। বঙ্গে তৃণমূল নেতারা বলেন, আমাদের লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পের বকেয়া সবার অ্যাকাউন্টে জমা। কন্যাশ্রী, রূপশ্রী। সবার ওপরে ‘সততার প্রতীক মমতা’। তাতে ইভিএম উপচে সমর্থন পড়ে।
কিন্তু এত যে কেলেঙ্কারি! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই যেজন্য সাফাই দিতে হচ্ছে, ‘সব আমি দেখি নাকি! আলাদা আলাদা দপ্তর আছে তো।’ কিন্তু দপ্তরগুলো কার অধীনে? সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রীর অধীনে। সেই মন্ত্রীদের মাথায় কে? মুখ্যমন্ত্রী আবার কে! মমতার কথায় রে-রে করে উঠছেন বিজেপি নেতারা, বললেই হল! তৃণমূলে একটাই পোস্ট, বাকি সব ল্যাম্পপোস্ট। মন্ত্রীসভায় সব সিদ্ধান্ত সেই ‘পোস্ট’ই নেন।
বিজেপির প্রত্যয়, দুর্নীতিতে আকণ্ঠ ডুবে আছে যে দলটা, তাদের মানুষ মেনে নেবে না। পদ্ম নেতারা বোঝাচ্ছেন, এত স্বজনপোষণ, এত স্বেচ্ছাচার! সন্দেশখালি, নারী নির্যাতন…। যতই দেখান লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, এ সবের সঙ্গে তাল পাবে না মশাই। মহিলারা ইভিএমে এমন জোরে বোতাম টিপছেন যে কলকাতায় তৃণমূল নেত্রীর মনে ‘কারেন্ট’ লাগছে। নীতি, আদর্শ কি বিজেপির মুখেও মানায়!
রায়গঞ্জের কৃষ্ণ কল্যাণীকে ২০২১-এ টিকিট দিয়েছিল বিজেপি। জিতে চলে গেলেন তৃণমূলে। শুভেন্দু অধিকারী হুমকি দিলেন, বাড়িতে ইডি ঢুকিয়ে দেবেন। এতই যদি অসৎ কৃষ্ণ, তাঁকে টিকিট দেওয়া হয়েছিল কেন? বিধায়ক পদ না ছেড়ে তিনি চলে গেলেন তৃণমূলে। গাছের খাব, তলারও কুড়োব কৌশলে দু’দিকের সব সুবিধা আদায় করে এখন ঘাসফুল প্রতীকে মনোনয়নপত্র পেশ করার আগে বিধায়ক পদটা ছাড়লেন আইন বাঁচাতে।
আগে দুই ঘাটের জল খাওয়া কার্তিকচন্দ্র পালকে রায়গঞ্জে প্রার্থী করেছে বিজেপি, যিনি শুধু বাম দল করা বাকি রেখেছেন। কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল ছুঁয়ে পদ্মঘাটে নোঙর করেই সাত রাজার ধন এক মানিক ভোটের টিকিট পেয়ে গিয়েছেন। কট্টর বাম, ফরওয়ার্ড ব্লকের তরুণ তুর্কি আলি ইমরান রমজ (ভিক্টর) আবার কংগ্রেসে ঢুকেই ‘হাত’ প্রতীক পেয়ে গিয়েছেন। বালুরঘাটের তৃণমূল প্রার্থী বিপ্লব মিত্র বিজেপি ছুঁয়ে এসেছেন। মালদা উত্তরের পদ্মপ্রার্থী খগেন মুর্মু মার্কসবাদের নামাবলি ছেড়ে গায়ে রামনামের গেরুয়া চাদর চড়িয়েছেন।
কার যে কী আদর্শ, কোন দলের প্রতি যে আনুগত্য, থই পাওয়া ভার। তবুও মানুষ এঁদের ভোট দেন অভ্যাসে। ভোটাধিকারের প্রতি আনুগত্যে। সেই সুযোগে যে যথেচ্ছাচার চলে, তাতে ভোটের টিকিটও পণ্য হয়ে যায়। নেতারা বেচেন। কিনে প্রার্থী হন কেউ কেউ। উত্তরবঙ্গে প্রার্থীপদের দাবিদার এক নেতাকে ফোনে জানানো হয়েছিল, টিকিটের বেস প্রাইস ৬ কোটি টাকা। নিলামে দর শেষপর্যন্ত কোথায় উঠবে, তার কূলকিনারা নেই ভেবে সেই নেতা রণেভঙ্গ দিয়েছিলেন।
খুব সম্প্রতি এক দলের তিন নীচুতলার নেতা অন্য ঘাটে নাও ভিড়িয়ে ভেট পেয়েছেন মোটা টাকা আর গাড়ি। দেড় কোটি টাকায় নাকি বিধায়ক কেনা যায়। নজির আছে আমাদের এই উত্তরবঙ্গেই। আদর্শ, নিষ্ঠা শব্দগুলি হারিয়ে গিয়েছে মহানন্দা, আত্রেয়ী, বালাসন, তিস্তা, জলঢাকার জলে। তৃণমূলের কথা আগে বলেছি, কিন্তু বিজেপি ভোট চাইছে কী কারণে? যেভাবে তৃণমূল বলে, আমাদের সততার প্রতীক আছে, ঠিক সেই ঢংয়ে পদ্ম নেতারা যুক্তি দেন, আমাদের মোদিজি আছেন যে। মোদি থাকলে দেশ নিশ্চিন্ত।
প্রশ্ন করুন, পেট নিশ্চিন্ত কি? জবাব আসে, এই তো মশাই, মাওবাদীদের মতো কথা বলছেন। ‘মোদির গ্যারান্টি’র প্রচারে শিল্পবিকাশ নেই, কৃষকের ফসলের ন্যায্যমূল্যের গ্যারান্টি নেই, উজ্জ্বলা যোজনার নিশ্চয়তাও নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচারেও শিল্প নেই, বন্ধ কারখানা খোলার কথা নেই, পরিযায়ী শ্রমিকদের ফিরিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। আছে নাকের বদলে নরুনের মতো লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের ভাতা, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে হুংকার।
স্লোগানেও দাবির কথা নেই। হয় বলতে হবে, ভারতমাতাআআআ কী জয় নতুবা জয় বাংলা। যদি বলেন, ভারতমাতার জয় বললে দু’বেলার খাবার নিশ্চিত তো! কিংবা জয় বাংলা বললে চাকরি মিলবে তো। শেষ অস্ত্র ধেয়ে আসে। প্রথম পক্ষ বলে, আরে মশাই, মোদিজি আছেন বলে আপনার হিন্দুত্ব নিরাপদে আছে। দ্বিতীয় পক্ষের ধমক শুনবেন, বিজেপির ভাষায় কথা বলবেন না। দিদি কী বলেন, শোনেন না? ‘জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব করে দিয়েছি। কিছু বাকি নেই।’
প্রথম পক্ষকে যদি জিজ্ঞাসা করেন, খ্রিস্টানরাও দেশের নাগরিক। তাঁরা নিরাপদ তো? ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা? উত্তর আসে, রাম মন্দির হয়েছে। এর চেয়ে নিরাপত্তা আর কোথায়? অনুচ্চারিত কথাটি বুঝে যাই, মন্দির হলে দু’বেলা দু’মুঠোর বা জীবিকার নিরাপত্তা থাকল কী গেল, তাতে কী যায় আসে!
দ্বিতীয় পক্ষকে যদি জিজ্ঞাসা করেন, দিদির জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব করে দেওয়ার মধ্যে চাকরিটা যে নেই। উত্তর মেলে, দিদি চাকরি নিয়ে রেডি। বাগড়া দিচ্ছে বিজেপি, সিপিএম। কথায় কথায় মামলা করছে। আদালত আটকে দিচ্ছে। কবে জট কাটবে? কী করে কাটবে? হাইকোর্ট বিজেপির বিচারালয় হয়ে গিয়েছে যে। এখন চাকরি ‘কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি…।’ আমার-আপনার ভোটটা দরকার, আমাদের নয়।