আলিপুরদুয়ারঃ রয়্যালটি, বেড, ট্রাক, ট্রলি, বেলচা- এরকম পাঁচ-সাতটা শব্দকে ধরেই বেঁচে থাকার রসদ খোঁজে পাতলাখাওয়া। আলিপুরদুয়ার-১ ব্লকের মধ্যমণি এই অঞ্চলের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে শিলতোর্ষা নদী। এই শিলতোর্ষাকে ঘিরেই জীবিকা বেছে নিয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। তাই পেটের টানে ‘পাচারকারী’-র তকমা জুটেছে অনেকের কপালে।
কখনও নদীকে কেন্দ্র করে বালি-পাথর তোলার জীবিকায় টান পড়া, কখনও রাঘববোয়ালদের ভাগবাঁটোয়ারার মাঝে পড়ে সংঘর্ষেও জড়িয়েছেন সেখানকার সাধারণ মানুষ। অনেকেই ওই এলাকা থেকে লুটেছেন রাজনৈতিক ফায়দাও। তবে আদতে পাতলাখাওয়া কী চায়?
নদী থেকে বালি তুলতে থাকা শিমলাবাড়ির রবিন ওরাওঁ বললেন, ‘নদী থেকে কাজ চাই। আর চাই শান্তি।’ এই নদীকে জড়িয়েই তো ওদের জীবন কাটে। তাই রবিনের সংযোজন, ‘কাজ করতে ভয় পাই না। তবে এই কাজ বন্ধ হয়ে গেলে অসহায় হয়ে পড়ি।’
একই কথা শোনা গেল ৪ নম্বর পাতলাখাওয়ার বাসিন্দা জয়ন্তী বর্মনের মুখে। তাঁর কথায়, ‘নদীতে যখন বালি-পাথর তোলা বন্ধ থাকে তখন ঠিক করে সংসার চলে না। বাড়ির ছেলেরা অনেকেই ভিনরাজ্যে চলে গিয়েছে কাজ না থাকায়।’ জয়দেব রায় যেমন বললেন, ‘এই শেষ ছয় মাস কাজ বন্ধ থাকায় বাইরে কাজ করতে গিয়েছিলাম। আবার কাজ শুরু হওয়ায় বাড়ি ফিরে এসেছি।’
শিলতোর্ষা নদীতে বালি-পাথর তোলা বন্ধ থাকাই সব সমস্যার মূলে। বলছেন বাসিন্দারা। এই নদীর বালি, খাদানগুলো আগে লিজ দেওয়া হত জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তরের তরফে। তবে ২০২১ সালের পর সেই নিয়ম বদলায়। বর্তমানে এই লিজ দেওয়ার কাজ হয় ওয়েস্ট বেঙ্গল মিনারেল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেড-এর মাধ্যমে। শেষ তিন বছরে ওই নদীতে নতুন করে কোনও খাদানের লিজ প্রক্রিয়া শেষ করতে পারেনি ওই সংস্থা। মাঝেমধ্যে ডাম্পিং ইয়ার্ডের বালি-পাথর বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়। সেটাই যেন সঞ্জীবনী। বালি-পাথর তোলা বন্ধ হলে বাড়ে পাচারের প্রবণতা।
তবে শুধু পরিযায়ী শ্রমিক হয়েই নয়, মাঝেমধ্যে ঘর ছাড়তে হয় পুলিশের ভয়েও। বালি-পাথর তোলাকে ঘিরে এলাকায় বেশ কয়েকবার ঝামেলা হয়েছে। আবার সেসব পাচার আটকাতে গিয়ে দুষ্কৃতীর হাতে আক্রান্ত হতে হয়েছে প্রশাসনের কর্তাদেরও। পুলিশ এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করতেই গ্রামগুলো হয়েছে পুরুষশূন্য। শুংশুঙ্গি মসজিদের পাশে মাচায় বসে এই কথাই বলছিলেন হাসিমা খাতুন, সাজ্জীনা বিবিরা। যে মাচায় কখনও গ্রামের ছেলেরা বসে আড্ডা দিত, বর্তমানে সেটা মহিলাদের আখড়া। হাসিমার কথায়, ‘এই এলাকায় এত মারামারি হয় তা নিয়ে আত্মীয়দের বাড়িতে গিয়েও কথা শুনতে হয়। আমরা এমন পরিবেশ চাই না। নদীতে ঠিক করে কাজ হলেই কোনও সমস্যা হবে না।’
নদীতে বালি-পাথর কীভাবে তোলা হয়, সরকারি নিয়মই বা কী সেই নিয়ে ওদের তেমন জানা নেই। ওই এলাকায় রাস্তার সমস্যা রয়েছে, পৌঁছায়নি পানীয় জলও। তবে গ্রামের মহিলারাই বলছেন, ‘নদীতে কাজ থাকলে উপার্জনের রাস্তা খোলা থাকবে, আর কিছু চাই না।’