ভাস্কর শর্মা, বক্সাদুয়ার: ইংরেজদের কঠিন-কঠোর অনুশাসন, নিয়মিত তীক্ষ্ম নজরদারি। তা সত্ত্বেও রবীন্দ্র জয়ন্তী পালনের দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন রাজবন্দিরা। তাও আবার দুর্গম বক্সা বন্দিশিবিরে। কথাগুলি বলছিলেন আলিপুরদুয়ার কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক তথা শিক্ষাবিদ অর্ণব সেন। আজ থেকে ৯৩ বছর আগে আলিপুরদুয়ারের (Alipurduar) বক্সা বন্দিশিবিরে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করেছিলেন বন্দিরা। কিন্তু আজ দেশ স্বাধীন। সম্প্রতি বক্সাদুর্গকেও ঢেলে সাজানো হয়েছে। কিন্তু সরকারি উদ্যোগে এখন আর হয় না রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন। ইংরেজ শাসনকালে দেশপ্রেমীরা যেখানে রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন, সেখানে স্বাধীন ভারতে বক্সায় কেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কোনও উদ্যোগ নেই তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ইতিহাসপ্রেমীরা।
‘অতীত আলোকে বক্সা’ গ্রন্থের লেখক নীতীশ দাসের কথায়, ‘সেলুলার জেলে রাজনৈতিক বন্দিরা অনশন ভেঙেছিলেন রবীন্দ্রনাথের নামে ও গান্ধিজির বার্তায়। তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে অগাধ শ্রদ্ধা করতেন। তেমনি বক্সা ক্যাম্পে রবীন্দ্র জয়ন্তী উপলক্ষ্যে কবিকে অভিনন্দন প্রেরণ ও কবির প্রত্যাভিনন্দন দেশে এক অদ্বিতীয় ঐতিহাসিক ঘটনা। কিন্তু কবির প্রেরিত চিঠির আজ হদিস নেই। এমনকি স্বাধীনতার পরে সেভাবে আর বক্সায় রবি স্মরণও করা হয় না। এটা আমাদের লজ্জা।’
বক্সা ফোর্টে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালনে কবিকে চিঠি প্রেরণ উত্তরে কবির প্রত্যাভিন্দনের বিষয়টি জানতে গেলে কিন্তু আজ থেকে ৯৩ বছর পিছিয়ে যেতে হবে। সে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। সময়টা ১৯৩১ সালের বৈশাখ মাস। বক্সাদুর্গে বন্দিরা সিদ্ধান্ত নিলেন এবার নোবেলজয়ী বাঙালির আবেগ রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালন করবেন। বিপ্লবীদের যেমন ভাবনা তেমন কাজ। শুরু হয় রবীন্দ্র জয়ন্তীর প্রস্তুতি। তবে তার আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একটি অভিনন্দনপত্র পাঠানোর বিষয়ে ঠিক হয়। রাজবন্দিদের একজন তা লেখেনও।
পরে তা বাঁশের নলের মধ্যে ভরে কবিগুরুর কাছে পাঠানো হয়। ২৫শে বৈশাখের দিন ভারতীয় রীতি মেনে বক্সা বন্দিশিবিরের সামনে মঞ্চ বানানো হয়েছিল। ভূপেন রক্ষিত, ভবেশ নন্দী, অনিল রায়, সুধীর বসুর মতো রাজবন্দিরা গোটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। অনুষ্ঠান জনগণমন গানের মাধ্যমে শেষ করা হয়।
এদিকে, বক্সা থেকে রাজবন্দিদের পাঠানো জন্মদিনের অভিনন্দনপত্র পৌঁছে যায় রবীন্দ্রনাথের কাছে। জানা গিয়েছে, ওই চিঠি পড়ে রবীন্দ্রনাথ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। প্রত্যুত্তরে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং রাজবন্দিদের উদ্দেশ্যে প্রত্যাভিন্দন লিখে পাঠান। যদিও ওই প্রত্যাভিনন্দ বন্দিদের হাতে পৌঁছায়নি। অনেকে মনে করেন চিঠিটি বক্সা ক্যাম্প অফিস থেকে কবির কাছে ফিরে যায়। তবে কবি নাকি পরবর্তীতে ওই চিঠি অমল হোম নামে একজনকে দিয়েছিলেন। ওই চিঠি তাঁর কাছেই ছিল। কিন্তু তার বেশকিছু কপি পরবর্তীতে বিভিন্ন জনের কাছে পৌঁছে যায়। তবে মূল কপি কার কাছে আছে তা নিয়ে অবশ্য সরকারও কিছু জানাতে পারেনি।
আলিপুরদুয়ার ডুয়ার্স সমাচারের লেখক রমেন দে বলেন, ‘রাজবন্দিদের চিঠি এবং কবির প্রত্যাভিনন্দনের প্রতিলিপি জোগাড় করেছিলাম। দেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে ওই চিঠি পাথরে খোদাই করে বক্সাফোর্টে লাগানো হয়েছে। এমনকি একটি স্মারকও তৈরি করা হয়। তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বক্সার স্বাধীনতা সংগ্রামী ও তাঁদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক জানাতে চাইলে ওই চিঠি একটি দলিল হতে পারে।’
আলিপুরদুয়ারের ইতিহাসপ্রেমীদের আক্ষেপ, ৮ মে আলিপুরদুয়ার জেলাজুড়ে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন হবে। এমনকি জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরও সরকারিভাবে অনুষ্ঠান করবে। কিন্তু এই জেলার দুর্গম পাহাড়ে আজ থেকে ৯৩ বছর আগে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন হয়েছিল। তখন ছিল দেশ পরাধীন। বক্সার বন্দিরাই ওই জন্মদিন পালন করেছিলেন। কিন্তু সরকারি উদ্যোগে এখন আর বক্সাতে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন হয় না।