প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লি: সেপ্টেম্বরে দিল্লি আসছেন? ছুটি কাটানোর প্ল্যান? গোছগাছ, বুকিং শেষ? তিষ্ঠ ক্ষণকাল! যদি সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে দিল্লি আসার কথা থাকে, সে ক্ষেত্রে কোনও অসুবিধা নেই, আপনাকে স্বাগত। কিন্তু ৫ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে যদি রাজধানী সফরের কথা ভেবে থাকেন, সেই পরিকল্পনা সময় থাকতে বাতিল করুন। না হলে অশেষ দুর্ভোগে পড়ার আশঙ্কা। কারণ দিল্লিতে এ মুহূর্তে বেশিরভাগ হোটেল, পাঁচতারা হোক বা সাত তারা, সাধারণ মধ্যবিত্ত হোটেল অথবা টু-থ্রি স্টার, আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় সমস্ত বুকড হয়ে গিয়েছে জি-২০ সম্মেলনের কথা মাথায় রেখে। ইতিমধ্যে বাতিল করা হয়েছে সমস্ত প্রি বুকিং। এমনকি, ধর্মশালা, পান্থশালা, লজ বা হোম-স্টে গুলিও কতটা খালি থাকবে সে সময়, তা স্পষ্ট করে বলা কঠিন। তা-ই সাধু সাবধান!
দিন কয়েক আগেই দিল্লিবাসীকে সম্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, “আগামী ৫ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর দিল্লিবাসীরা রাস্তাঘাটে চলা ফেরা করতে গিয়ে প্রভূত সমস্যার মুখে পড়বেন। বাস, মেট্রো, ট্রেন, অটো কিছুই যথাযথা পাওয়া যাবে না। পাওয়া যাবে না হোটেলও৷ জি-২০ এর জন্য এই সমস্যা, যার জন্য আমি আগাম ক্ষমা প্রার্থনা করছি৷” প্রধানমন্ত্রী ভুল বলেননি।
বিশেষ সূত্রে পাওয়া খবরে, দিল্লির অধিকাংশ হোটেলে ঝুলছে ‘নো রুম’ বোর্ড। ৯-১০ সেপ্টেম্বরে জি ২০ সামিটকে কেন্দ্র করে নয়াদিল্লির শতাধিক হোটেলে ৩৫০০-র বেশি রুম বুক করে ফেলেছে কেন্দ্রীয় সরকার। সেন্ট্রাল দিল্লি, এয়ারোসিটি বা গুরুগ্রাম অঞ্চলের তিন থেকে পাঁচতারার সমস্ত হোটেল দখল করেছে সরকার। এর মধ্যে ৩০টি প্রধান হোটেল, অতিথিনিবাসে প্রায় ১০ হাজার ‘হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট প্রফেশনাল’ বহাল করা হয়েছে। দু-মাস আগে থেকেই দিল্লি পুলিশ, স্পেশাল ব্রাঞ্চ, আইবি, বিদেশ মন্ত্রক ও বিভিন্ন দূতাবাসগুলি হোটেলে শুরু করেছে ‘সিকিউরিটি ড্রিল’।
৭-১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাখা হবে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা বলয়, যেখানে মাছিটিও গলতে পারবে না বলে দাবি করেছেন সামিটের দায়িত্বে থাকা এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক। স্বাভাবিক ভাবেই, সাধারণ মানুষ অথবা টুরিস্টের সেখানে প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধ। বাতিল করা হয়েছে যাবতীয় প্রি বুকিং। ১৫ সেপ্টেম্বরের পর, অতিথি অভ্যাগতরা বিদায় নিলে আস্তে আস্তে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা, তার আগে নয়।
বিভিন্ন পাঁচতারা-সাত তারা হোটেলের তরফেও জি-২০ সম্মেলনে আগত অতিথিদের বরণ করে নিতে বিশেষ আয়োজন করা হয়েছে। ভারতীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের কথা মাথায় রেখে নানা প্রান্ত থেকে উড়িয়ে আনা হচ্ছে সাংস্কৃতিক দল এবং সংগীতশিল্পীদের। ‘ভারতীয় সংগীত, শাস্ত্রীয় অথবা লঘু, বিদেশীরা বরাবর আকৃষ্ট হন তাতে। সেই বিষয় নজর রেখে আইটিসি মৌর্য, তাজ প্যালেস, স্যাংগ্রিলা, মেরিডিয়ান, ইমপেরিয়াল বা পার্ক হোটেলে দেশের সেরা সংগীত-শিল্পীদের নিয়ে আসা হবে। বিশেষ করে তবলা, সেতার, ঢোল, সরোদ, শানাইতে পারদর্শীদের দেওয়া হবে বিশেষ সুযোগ। অতিথিদের মনোরঞ্জন করতে তারা সংগীত পরিবেশন করবেন। সেই হোটেলে বন্দোবস্ত করা হচ্ছে শিল্পীদের থাকা-খাওয়ার’- জানিয়েছেন এক শীর্ষ কর্তা।
অতিথিদের রসনা নিবৃত্তিতেও কোনও আপোষ করা হচ্ছে না বলে দাবি করেছেন তিনি। জি-২০ অতিথিদের জন্য বিশেষ ‘ওয়েলকাম ড্রিঙ্ক’, আঞ্চলিক ব্যঞ্জন সহ হরেক কিসিমের উপাদেয় ‘চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়’ এর বন্দোবস্ত করা হচ্ছে, যার যাবতীয় বিবরণ তত্ত্বাবধান করছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব স্তরীয় আধিকারিকরা।
ইতিমধ্যেই জানা গিয়েছে, ‘আইটিসি মৌর্য’তে থাকবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ‘তাজ প্যালেসে’ চিনা প্রিমিয়ার শি জিনপিং, ‘স্যাংগ্রিলা’য় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক এবং জার্মান প্রতিনিধি দল, ‘ইম্পেরিয়ালে’ অস্ট্রেলিয় প্রধানমন্ত্রী ও ইন্দোনেশিয় প্রতিনিধি, ‘হোটেল ললিতে’ কানাডা ও জাপানি প্রতিনিধিরা থাকবেন। এই সব হোটেলে অতিথিদের রসনা নিবৃত্তির দায়িত্বে থাকবেন প্রায় ২০০০ শেফ ও অ্যাসিস্ট্যান্ট শেফ।
পাশাপাশি অন্যান্য ছোট, মাঝারিমানের হোটেল, রেস্টুরেন্ট গুলিও দখল করা হয়েছে জি-২০ তে কর্মরত আধিকারিকবৃন্দ ও কর্মচারীদের জন্য। সম্মেলনের কটা দিন বাড়ি ফিরতে পারবেন না কেউ, থাকতে হবে দিল্লির বিভিন্ন হোটেলে, কড়া নিরাপত্তার ঘেরাটোপে। হোটেলে কোনও ত্রুটি বা বিচ্যুতি ধরা পড়লে, তক্ষুনি তা দ্রুত হাতে সারাই করতে হবে বলে হোটেল কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়েছে সরকারি নির্দেশ। নিরাপত্তার জন্য প্রতিটি হোটেলে বহাল করা হবে পর্যাপ্ত সুরক্ষাকর্মীও। ত্রিস্তরবিশিষ্ট সুরক্ষা বলয়ে মোড়া হবে যাবতীয় ‘ভিভিআইপি’ অতিথি নিবাসগুলিকে। বেশ কিছু হোটেলে বসানো হচ্ছে বুলেটপ্রুফ গ্লাস, আলাদা সার্ভিলেন্স রুম।
দিল্লির উপ রাজ্যপাল ভি কে সাক্সেনার অধীন বিশেষ টিম সমস্ত হোটেল ঘুরে তদারকি শুরু করেছে। যাতে লোডশেডিং না হয় তার জন্য রাখা হচ্ছে যথেষ্ট পাওয়ার ব্যাকআপ ও স্টোরেজ সিস্টেম। একইসাথে রাখা হয়েছে মেডিকেল টিম, অ্যাম্বুলেন্স, প্যারামেডিক্স সহ অন্য স্বাস্থ্য কর্মীদের। আমন্ত্রিত অতিথিরা আসা মাত্র গোটা অঞ্চল যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হবে ও প্রয়োজনে বদল করা হবে রুটও।