প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লি: শিল্পোন্নয়নের উদ্দেশ্য শুধু রাজ্যস্তরে শিল্পের বিকাশই নয় বরং রাজ্যের সামগ্রিক উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা। মানুষের হাতে অর্থ তুলে দিয়ে বাজার চাহিদা গড়ে তোলাই শিল্পের বিকাশের উদ্দেশ্য যা করতে ব্যর্থ হয়েছে মোদি সরকার, এবং তাই করে দেখিয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার দিল্লির তাজ প্যালেস হোটেলে আসন্ন ‘বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিটে’র প্রেক্ষাপটে দেশের প্রথম সারির শিল্পপতিদের পাশে বসিয়ে এমনই দাবি করলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর প্রধান উপদেষ্টা ড. অমিত মিত্র৷
এই প্রসঙ্গেই এদিন মোদি সরকারের নীতির তীব্র সমালোচনা করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। বুধবার নয়াদিল্লিতে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে অমিত মিত্র বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গ সরকার সরাসরি সাধারণ মানুষের হাতে অর্থ তুলে দিচ্ছে কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী তথা লক্ষ্মীর ভান্ডারের মত একাধিক প্রকল্পের মাধ্যমে৷ এর ফলে বাজার অর্থনীতিতে চাহিদা তৈরি হচ্ছে। মোদি সরকার এর বিপরীত কাজ করেছিল। করোনাকালে তারা কর্পোরেট-দের ২০ শতাংশ ছাড় দিয়েছে তাঁরা। ওই ছাড়ে সাধারণ মানুষের কোনও লাভ হয়নি। বরং লাভ হয়েছে দেশের শিল্পোদ্যোগীদের, তাদের মুনাফা বেড়েছে৷’ অমিতবাবুর দাবি, ‘ওই সময় বাজারে চাহিদা ছিল না, ফলে জোগান বাড়ানোর জন্য শিল্পপতিদের ২০ শতাংশ ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল সম্পূর্ণ ভুল৷’
এই মর্মেই বর্ষীয়ান অর্থনীতিবিদের সংযোজন, ‘প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগন এই নীতি গ্রহণ করেছিলেন, যা ‘রেগন থিওরি’ নামে পরিচিত৷ সেই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পে ভাঁটা দেখা দেয়৷ ফলে রেগন আশা করেছিলেন যে তাদের শিল্পগুলিকে বিশেষ ছাড় প্রদান করা হলে তা শিল্পে জোয়ার আনবে৷ ভারতের ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত প্রয়োগ ভুল ছিল৷ করোনা কালে দেশে কোনও চাহিদাই ছিল না৷ এই ভুল নীতি গ্রহণ না করে সঠিক ভারসাম্য বজায় রেখেছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ‘কেইনশিয়ান মেথড’ মেনে সরাসরি রাজ্যের লোকের হাতে টাকা প্রদান করেছিল৷ সামাজিক খাতে এহেন ব্যায়বরাদ্দ বাড়িয়েছিল রাজ্য৷ গতবছর এই খাতে ৮২,১৮০ কোটি টাকা খরচ করেছে রাজ্য সরকার৷’
প্রসঙ্গত, ২১-২২ নভেম্বরে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হবে সপ্তম বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট (বিজিবিএস)৷ অন্যান্য বারের মত এবারও এই আন্তর্জাতিক শিল্প সম্মেলনকে সাফল্যমন্ডিত করার লক্ষ্যে বিশেষ ভাবে উদ্যোগী হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার৷ এই উপলক্ষে রাজধানী দিল্লিতে এসে টানা দু দিন ধরে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচির রূপদানে ব্যস্ত থেকেছেন অমিত বাবু৷ মঙ্গলবার বিশ্বের ৪০টি দেশের কূটনীতিকদের সামনে বাংলার শিল্প সম্ভাবনার গুরুত্বপূর্ণ ব্লু প্রিন্ট তুলে ধরেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধান উপদেষ্টা ড. অমিত মিত্র৷ এর পরে বুধবার দেশের প্রথম সারির সাতটি শিল্পোদ্যোগের প্রধানদের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন অমিত বাবু৷ এরা প্রত্যেকেই বাংলায় বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করেছেন এবং তাদের ব্যবসা দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে৷ এর মধ্যে ছিলেন টিটাগড় রেল সিস্টেমস-র শীর্ষ কর্তা পৃথ্বীশ চৌধুরী, আইটিসি গ্রুপের মি. সুমন্ত, টাটা ইন্টারন্যাশনাল লজিসটিক্স লিমিটেডের এম ডি দীনেশ শাস্ত্রী, ওয়াও মোমো-র প্রধান সাগর দরিয়ানি এবং আমরি গ্রুপের অন্যতম শীর্ষ কর্তা রূপক বড়ুয়া৷
দেশের প্রথম সারির শিল্পোদ্যোগের সঙ্গে জড়িত এই শিল্পকর্তারা প্রত্যেকেই রাজ্যের শিল্পবান্ধব পরিবেশের প্রশংসা করেন৷ এই মর্মেই টাটা গোষ্ঠীর শিল্প কর্তা দীনেশ শাস্ত্রী আভাস দেন রাজ্যের ২৯৫টি নদীকে ভিত্তি করে তারা ইন-ল্যান্ড ওয়াটারওয়েজ বা জলপথে পণ্য পরিবহন ব্যবসার সম্প্রসারণের উপরে জোর দেবেন৷ কলকাতাকে দেশের ‘ফুড ক্যাপিটাল’ বলে দাবি করেন দৈনিক ১০ লক্ষ মোমো প্রস্তুতকারক ‘ওয়াও মোমো’ সংস্থার কর্ণধার, কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের প্রাক্তনী সাগর দারিয়ানি৷ অদূর ভবিষ্যতে রাজ্যে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণে বড় বিনিয়োগের আভাসও দেন তিনি৷ তাঁর মতে, ‘একজন চা ওয়ালা যদি দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়, বাংলা থেকেও মোমো শিল্পে বিপ্লব আসতে পারে।’
দেশের অন্যতম বিখ্যাত শিল্প সংস্থা আইটিসির অন্যতম প্রধান কর্তা মি: সুমন্তও রাজ্যের শিল্প পরিবেশের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন৷ তাঁর কথায়, ‘আমরা রাজ্য সরকারের থেকে অভূতপূর্ব সহযোগিতা পেয়েছি৷ বাংলা বিনিয়োগের জন্য দারুণ জায়গা৷’ বাংলায় ইতিমধ্যে ৪৭০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ করেছে আইটিসি, জানিয়েছেন সুমন্ত। টিটাগড় রেল ওয়ার্কসের পৃথ্বীশ চৌধুরী বলেন, ‘রাজ্যের শিল্পবান্ধব পরিবেশে ৮০ টি বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের কোচ তৈরি হচ্ছে হুগলির উত্তরপাড়ায়। পুণে এবং বেঙ্গালুরুতেও মেট্রো কানেক্টিভিটি তৈরি হচ্ছে বাংলা থেকেই। এ এক অসামান্য সাফল্য।’ বাংলার ‘স্বাস্থ্যসাথী’ প্রকল্পের ভূয়সী প্রশংসা করেন আমরি গ্রুপের অন্যতম শীর্ষ কর্তা রূপক বড়ুয়াও। শিল্পপতিদের এহেন উচ্ছ্বাসের সূত্রেই ড. অমিত মিত্রর সংযোজন, ‘দেশের প্রথম সারির শিল্পপতিদের অভিজ্ঞতাই বলে দিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গই এখন দেশের সেরা বিনিয়োগ স্থান৷ আগামী দিনেও এর সম্ভাবণার রাস্তা আরও প্রশস্ত হবে।’