- সেবন্তী ঘোষ
আশপাশের এলাকা থেকে এগিয়ে থাকা স্বর্গ-সুবিধাযুক্ত একটা শহরে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের সংখ্যা বাড়ে, সঙ্গে বহিরাগতদের আনাগোনাও। রাস্তাঘাটের উন্নতি হওয়ায় দ্রুতগামী মোটরবাইকে দূরদূরান্ত থেকে ছেলেদের আনাগোনা সহজ হয়। তার ওপর যেখানে-সেখানে দোকান, বাজার থাকলে এই অচেনা মানুষদের ঠেকানো কার্যত অসম্ভব।
আগে পাড়ায় অপরিচিত মুখ দেখলে প্রশ্নের চোখ চলে যেত। এখনকার শিলিগুড়ি সদা ভ্রাম্যমাণ। বাঘাযতীন পার্ক থেকে হাতি মোড়, কলেজপাড়ায় সর্বদা নানা অনুষ্ঠান, মিছিলের মেলা। অজস্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী ও তাদের কারণে পিজি, হস্টেল গিজগিজ করছে। এই বাজারের মতো রাস্তায় দিনেদুপুরে শিলিগুড়িতে দুটি মেয়েকে যারা উত্ত্যক্ত, হেনস্তা করার সাহস অর্জন করল, তারা বেপরোয়া হতে পারে কিন্তু একেবারে নির্বোধ নয়। একেবারে অচেনার জন্য দ্রুত কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ার দুঃসাহস দেখাবে না, এটা তাদের হিসেবের মধ্যেই ছিল। তার মধ্যে অবশ্যই ছিল শাস্তি না পাওয়ার ভয় এবং সেই নির্ভয়ের ঔদ্ধত্য। হাতি মোড় থেকে ভেনাস মোড়, দুটো লজ্জাজনক ঘটনা তারই প্রমাণ।
আমরা যারা অর্ধশতাব্দীর বেশি এই এলাকার বাসিন্দা, তারা নিজের পাড়ায় সুরক্ষিতই ছিলাম বলা যায়। তখনও এবং এখনও প্রতিটি অলিগলিতে পুলিশের পাহারার ভরসায় আমরা থাকিনি। বাস্তবে সেটা কখনও সম্ভব নয়। কিন্তু জানতাম আশপাশের বাড়ি থেকে বা রাস্তাঘাট থেকে প্রতিবাদ আসবে। সুভাষপল্লির হাতি মোড়ে যেখানে একটি ফলওয়ালা এক বাইক আরোহীকে দুষ্কৃতীদের পশ্চাদ্ধাবনের কথা বলেন, সেই মানুষটি রাজি হলেন না। আশপাশে যাঁরা এই হেনস্তার ঘটনা দেখলেন তাঁরা কেউ প্রতিবাদ করলেন না। এটিই হল সবচেয়ে হতাশার। সমাজ, মানবিকতা, সমবেদনা বস্তুটি হঠাৎ এত বায়বীয় হয়ে গেল?
তবে উত্তরে এটাও বলতে হয়, কোথায় যেন একটা সার্বিক নিয়ন্ত্রণহীনতা কাজ করছে। অচেনা মানুষটির প্রতি সহানুভূতি থাকলেও যারা দিনেদুপুরে দুঃসাহসের পরিচয় দেয়, তাদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকতে পারে, এই সম্ভাবনাও হয়তো সাধারণ নাগরিকের মনে খেলে যায়। অনেক ক্ষেত্রে ধরা পড়লেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না। হয়তো এইসব কারণও সাধারণ নাগরিককে উদাসীন ও স্বার্থপর করে তুলেছে। তবু ভালো ভেনাস মোড়ের ঘটনায় অপরাধীকে সঙ্গে সঙ্গে ধরা হয়েছে। সেখানে হিলকার্ট রোডের ব্যবসায়ীদের কৃতিত্ব দিতে হবে। সেই সচেতনতা সামান্য দূরের হাতি মোড়ের ব্যবসায়ীরা দেখাতে পারলেন না?
আপাতভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সংহতির ওপর এই শহরের ভরসা আছে। আশা করা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রশাসন, দল, বিরোধী দল প্রত্যেকেই সচেষ্ট হবে। তবে আমাদের মতো সাধারণ মানুষকেও ভাবতে হবে, আজ পাশের বাড়িতে আগুন লেগেছে বলে কাল আমার বাড়িতে লাগবে না, সেটা কি আমরা নিশ্চিতভাবে জানি? একজন রুখে দাঁড়ান, তাহলে অবশ্যই পাশের জন সাহস পাবেন আপনার পাশে দাঁড়াতে।
(লেখক শিলিগুড়ির শিক্ষক ও সাহিত্যিক)