অলকেশ বন্দ্যোপাধ্যায়
ডাকছে আকাশ, ডাকছে বাতাস, ডাকছে মাঠের সবুজ ঘাস/ ও ছেলেরা খেলা ফেলে শুধুই কেন পড়তে যাস!…ও ছেলেরা ও মেয়েরা দেশের দশের চোখের মণি/ কাদা ধুলো মেখে মাঠে, সবুজ হ না একটুখানি…
সেই সবুজ ঘাসে ভরা খেলার মাঠই বা কোথায় আর একান্নবর্তী পরিবারই বা কোথায়! আগের সেই পাড়া নেই, বাবা-মায়ের সময় নেই, বাড়িতে শিশুর কোনও সঙ্গী নেই, মনের মতো বন্ধু নেই, রূপকথার অলীক কল্পনার জগৎও নেই। তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছে শিশুমন। এই শিশু-কিশোরদের বীভৎস কাণ্ডকারখানায় শিউরে উঠতে হয় টিভি খুললে বা খবরের কাগজের পাতা উলটালে। পুরুলিয়ার এমনই একটি ঘটনা নজর কেড়েছে সারা দেশের। ছাত্রমৃত্যুর কারণে স্কুল ছুটি থাকবে, এই লোভে প্রথম শ্রেণির এক ছাত্রকে মাথা থেঁতলে খুন করেছে অষ্টম শ্রেণির এক পড়ুয়া। কত তুচ্ছ কারণে এক কিশোর হত্যা করল পাঁচ বছরের শিশুকে। শিশুমন কীভাবে বিষিয়ে যাচ্ছে দিন-দিন, এই একটি ঘটনা তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
শিলিগুড়ি থেকে মালদা, অনেক জায়গা থেকেই ইদানীং খবর আসছে তরুণ- তরুণীদের আত্মহননের। শুধু বয়স্কদেরই নয়, অবসাদ গ্রাস করছে শিশু থেকে কিশোর-কিশোরীদেরও। তাদের শারীরিক সক্ষমতা কমে যাচ্ছে, মেজাজ হয়ে যাচ্ছে খিটখিটে, জেদি হয়ে যাচ্ছে দিন-দিন। ‘ছোট পরিবার সুখী পরিবার’-এর নিয়ম মেনে এখন একটিই সন্তান। সাধ্যের বাইরে গিয়েও বাবা-মা তার সাধ পূরণের চেষ্টা করে। পেতে পেতে তার চাহিদা হয়ে যাচ্ছে আকাশছোঁয়া। চাহিদা পূরণ না হলেই হয় বাবা-মায়ের সঙ্গে অশান্তি, না-হয় বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া, নয়তো আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া কিংবা ব্যর্থ প্রেমের হতাশা অথবা বাবা-মায়ের ওপর অভিমান করেও নিজের জীবন শেষ করে দিতে দ্বিধা করছে না এরা।
অথচ ভাবলে অবাক লাগে, শৈশবে আমাদের প্রজন্মের শিশুরা অল্পতেই কত খুশি থাকত। সেই অর্থে আনন্দের কোনও উপকরণ ছিল না। না ছিল টিভি, না ছিল মোবাইল, না ছিল ইন্টারনেট। ল্যান্ডলাইন ফোনও ছিল না বাড়িতে বাড়িতে। গোটা পাড়ায় হয়তো একটি বাড়িতেই থাকত সেই ফোন। কারও দরকার হলে সেই বাড়ি থেকেই ফোন করত। আমাদের ‘কলসেন্টার’ ছিল বাড়ির কাছাকাছি দুটি দোকানে। তখন পারস্পরিক সম্পর্ক এত মধুর ছিল, আমরা যখনতখন গিয়ে হাজির হলেও কখনও তাঁরা বিরক্ত হতেন না। তখন প্রাচুর্য ছিল না জীবনে। কিন্তু বছরের ৩৬৫ দিনই ছিল উৎসবময়।
আমাদের শৈশবে মার্বেল খেলায় ক’টা মার্বেল জিতলে বা ঘুড়ি-লাটাই নিয়ে ছাদে অন্যের ঘুড়ি ভোকাট্টা করলেও ছিল একটা স্বর্গীয় আনন্দ। কখনও ডাংগুলি, কখনও পিট্টু, আবার কখনও দিদিদের সঙ্গে চু কিতকিত, এক্কাদোক্কা খেলার মধ্যেও ছিল সেই অনাবিল আনন্দ। টিফিনের সময় স্কুলের সামনে আসত শোনপাপড়িওয়ালা। দশ পয়সা দিয়ে ঠিকঠাক লটারি লাগাতে পারলে মিলত এক ডজন শোনপাপড়ি। কিন্তু সে আর জুটত কোথায়! যতবারই ঘোরাই, একটি বা দুটি শোনপাপড়িই ছিল প্রাপ্য। গ্রীষ্মের দুপুরে রংবেরংয়ের কাঠি- আইসক্রিম বা শীতের সন্ধ্যায় বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়া ফুলকপির ঘুগনি, মটরভাজার কথা মনে পড়লে এখনও জিভে জল আসে। তবে সবচেয়ে লোভনীয় ছিল, মা-জেঠিমারা সিনেমা দেখতে গেলে আমাদের জন্য আসত খোসাসমেত বাদামের একটি করে প্যাকেট। তার মধ্যে থাকত নুন-লংকাগুঁড়ো দিয়ে মোড়া একটি কাগজের পুরিয়া। এটার জন্যই আমরা ভাইবোনরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম।
আমাদের বয়সি ছেলেমেয়েদের সেই আমলে সিনেমা দেখার ছাড়পত্র ছিল না। কালেভদ্রে মহাতীর্থ কালীঘাট, দক্ষযজ্ঞ বা ত্রিনয়নী দুর্গার মতো ঠাকুরদের ছবি বা গুপি গাইন বাঘা বাইনের মতো ছোটদের ছবি দেখার অনুমতি ছিল। আমাদের মতো আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত পরিবারেও ছিল একই চিত্র। এখন ভাবি, হলে গিয়ে সিনেমা দেখা নয়, সামান্য বাদামের একটি প্যাকেট পেলেই কত খুশি হতাম আমরা।
এখনকার মতো তখনও প্রতি শুক্রবার নতুন ছবি শুরু হত। সেদিন সকাল থেকে সারা শহরে রিকশা করে মাইকে প্রচার করা হত নতুন ছবি, নায়ক-নায়িকার নাম, ম্যাটিনি-ইভনিং-নাইট শো’র সময়সূচি। ঘোষকের বলার একটা বিশেষ স্টাইল ছিল। মারকাটারি হিন্দি সিনেমা হলে ঘোষকের বুলি ছিল বাঁধা, নাচে গানে ফাইটিংয়ে ভরপুর সুপারহিট ছবি।
সত্যি বলতে কি, সেই সময়ে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে ছোটদের চাহিদা ছিল খুবই অল্প। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে কোনও মাথাব্যথাই ছিল না। স্কুলের কোনও কোনও বন্ধু গ্রীষ্ম বা পুজোর ছুটির পর এসে তাদের বিভিন্ন জায়গায় বেড়ানোর গল্প শোনাত। কিন্তু কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি বলে কোনও আক্ষেপ ছিল না আমাদের মনে। মাঝেমধ্যে স্কুলে বা বাড়িতে বাবা-মায়ের কাছে বকুনি-মারধর যে জুটত না, তাও নয়। তবে সেটা নিয়ে রাগ-অভিমানের বালাই ছিল না। একবার রাত্রিবেলায় রেগে গিয়ে বাবা আমাকে আর ছোড়দাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল। আমরা দুই ভাই দরজার বাইরেই চুপচাপ বসে ছিলাম। কোথাও পালিয়ে যাওয়ার কথা কল্পনাতেও আসেনি। অনেক পরে বহু রাত্রে রান্নার মাসি আমাদের ভেতরে নিয়ে আসে। আজকালকার ছেলেমেয়েরা হলে কিছু না কিছু কাণ্ড ঘটিয়ে দিত।
সেই জমানায় আমাদের ‘নেই রাজ্যে’ সবেধন নীলমণি ছিল রেডিও। বাড়িতে বাড়িতে বিনোদনের একমাত্র উপকরণ। জগৎ সংসারের খবর আমরা রেডিওর মাধ্যমে পেয়ে যেতাম। কিন্তু রেডিও’র প্রতি আমাদের দুর্নিবার আকর্ষণের প্রধান কেন্দ্র ছিল অনুরোধের আসর, শুক্রবার রাতের নাটক, গল্পদাদুর আসর, রবিবার রাতের ছায়াছবির গান। আর ফুটবল-ক্রিকেটের ধারাবিবরণী। তখন টেস্ট ক্রিকেট হত শীতের সময়ে। বিল লরির অস্ট্রেলিয়া, ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আসিফ ইকবালের পাকিস্তান আসত খেলতে। ‘নমস্কার, ইডেন উদ্যান থেকে বলছি পুষ্পেন সরকার’- এখনও সেই কণ্ঠস্বর ভেসে আসে কানে। মোহনবাগান বনাম ইস্টবেঙ্গল আইএফএ শিল্ড ফাইনাল বা কলকাতা লিগের ম্যাচের ধারাভাষ্য শোনার জন্য সকাল থেকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। এমনিতে রবিবার ছিল আমাদের প্যাকড প্রোগ্রাম। বিবিধ ভারতীতে দুপুরে হরলিক্স গানের আসর। তারপর কলকাতা ক-এ সারাদিন ধরে একের পর এক অনুষ্ঠান। সব শেষে রাত সাড়ে ন’টায় ছায়াছবির গান। অনুষ্ঠানের শেষদিকে যখন তিন ভুবনের পারে, মন নিয়ে, দেয়া নেয়া- ছবির গানগুলো হত, মন খারাপ হয়ে যেত। আবার অপেক্ষা এক সপ্তাহের। এসবই এখন ইতিহাস।
এই প্রজন্মের শিশুদের জন্য কষ্টই হয়। তারা এই নির্মল আনন্দের স্বাদই পেল না। উলটে মোবাইলের প্রতি আসক্তি তাদের নিয়ে যাচ্ছে ধ্বংসের পথে। এটাই বাবা-মা’র মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হচ্ছে তারা। মনোবিদদের মতে, এর জন্য দায়ী বাবা-মায়েরাও। বাচ্চাকে তাড়াতাড়ি খাওয়ানোর জন্য হাতে মোবাইল তুলে দিচ্ছে। বাচ্চারাও কার্টুন দেখতে দেখতে খেয়ে নিচ্ছে। সেসময় জরুরি ফোন এলেও ধরার উপায় নেই। পরিবেশ দূষণ নিয়ে রাষ্ট্রনেতা, বিজ্ঞানী, সমাজকর্মীদের মাথাব্যথার শেষ নেই। অথচ নিঃশব্দে বিষিয়ে যাচ্ছে শিশুমন। বয়সের আগেই বড় হয়ে যাচ্ছে তারা। কিন্তু তা নিয়ে কারও হেলদোল নেই।
লেখা শুরু হয়েছিল একটা আক্ষেপ দিয়ে। শেষ করি আশার বাণী দিয়ে। আসুন, আমরা সবাই মিলে শিশুদের আবার নিয়ে যাই সেই রূপকথার কল্পনার জগতে।
আয় আয় কে যাবি, আয় কে মন হারাবি/ এক মুঠো রোদ ধরতে…