- অনুপ দত্ত
তোমাকে পেতেই হবে শতকরা অন্তত নব্বই (বা নব্বইয়ের বেশি)।
তোমাকে হতেই হবে একদম প্রথম…
কবি জয় গোস্বামী লিখেছিলেন প্রথম হওয়ার গল্প। শিলিগুড়ির কলেজপাড়ার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া দেবজ্যোতি সরকারও প্রথম হতে চেয়েছিল। পারেনি। ‘প্রথম’ না হওয়ার যন্ত্রণা থেকে মুক্তও হতে পারেনি। তাই চিরকালের জন্য জীবন থেকে ছুটি নিয়েছে দেবজ্যোতি। জলপাইগুড়ি জেলায় ক্রান্তির ইতিহাসের ছাত্র জাহিদ কবিরও নিজেকে ‘প্রথম’ প্রমাণ করতে পারেনি। সোমবার সন্ধ্যায় নিজেকে ‘ব্যর্থ সন্তান, ব্যর্থ দাদা’.. মন্তব্য লিখে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে আত্মহত্যা করেছে।
প্রথম হওয়ার এই প্রতিযোগিতা যেন সবসময় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তরুণ প্রজন্মকে। পিছিয়ে পড়লেই যেন সব শেষ। তখনই চেপে বসে মানসিক অবসাদ। পরিণতি অনেক সময় অাত্মহত্যা। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১০ থেকে ৪৫ বছর বয়সিদের আত্মহত্যার প্রবণতা মারাত্মকভাবে বেড়েছে। কোথাও সামান্য ব্যর্থতা বা মনের ইচ্ছেয় ন্যূনতম আঘাত লাগলেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে অনেকে। খবরের কাগজে চোখ রাখলে নজরে পড়বে, মায়ের বকুনি খেয়ে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রটি আত্মহত্যা করেছে। কিংবা আবদার মেনে মোবাইল না দেওয়ায় নবম শ্রেণির ছাত্রী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
এই তো সেদিনের ঘটনা। ধূপগুড়ির অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী কোয়েল শর্মা সরস্বতীপুজোর দিন বাড়ির কাছে জলসা দেখতে যাবে বলে বায়না ধরেছিল। মা যেতে দেননি। ছাত্রীটি কী করল? সকলের অজান্তে ঘরের দরজা বন্ধ করে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করল। অনুষ্ঠানে যেতে না করায় তার অভিমান হয়েছিল। তাতেই নিজেকে শেষ করে দেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ছাত্রীটি। জীবনে কখন যে কী ঘটে যায়, তার কার্যকারণ সবসময় বাইরে থেকে বোঝা সম্ভব হয় না। আসলে আমাদের মন বোঝার ক্ষমতাটাই হারিয়ে গিয়েছে।
গত মাসের ঘটনা। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় কুশমণ্ডির গোবরাবিলের নবম শ্রেণির ছাত্রী রত্না সরকার মামাবাড়িতে কয়েকদিন থাকতে চেয়েছিল। ওর মা তাতে রাজি হননি। এরপর ছাত্রীটি বাড়ি ফিরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। খুবই তুচ্ছ কারণ। পরিবার কল্পনাও করতে পারেননি যে, এমনটাও হতে পারে। আসলে আমরা সন্তানদের মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করি না। ছোট থেকেই পিঠে ১০ কেজির বোঝা চাপিয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দিই। কিছুতেই বুঝতে চাই না যে, সন্তান মনের ভিতর দ্বিগুণ বোঝা নিয়ে বড় হচ্ছে।
আমাদের সেদিকে খেয়াল থাকে না। আমরা সন্তানকে প্রথম হওয়ার লড়াইয়ে নামিয়ে দিই। তার কানে সবসময় মন্ত্র দিই, তোমাকে শতকরা পেতেই হবে অন্তত নব্বই বা তার বেশি। তার মনের ভিতর কী চলছে, সে কী চায় ইত্যাদি কখনও জানতে চাই না। আমরা কখনও তার হাতে-পায়ে মাটির গন্ধ পেতে চাই না। কিংবা হাতে ধরিয়ে দিই না ঘুড়ির সুতো। একই বালিশে দুজনে মাথা দিয়ে তাকে শোনাই না ঠাকুমার ঝুলির গল্প! কখনও দাওয়ায় বসে সকলে মিলে একসঙ্গে গেয়ে উঠি না, কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা।
আমরা তো সন্তানকে আলতো পায়ে শিশির ছোঁয়াতে দিই না। ভালো মানসিকতা গড়ে তোলার জন্য তাকে কখনও সুপরামর্শ দিই না। আমরা তো তাকে প্রতিযোগিতার রেসকোর্সের বাইরে দেখতেই চাই না। ছোট থেকে সন্তান খেতে না চাইলে তার হাতে ধরিয়ে দিই অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল। তাতে কত গেম, কত রঙিন খেলা দেখতে দেখতে সে চুপ করে খেয়ে নেয় খাবার। মোবাইল দেখতে দেখতে সন্তান বড় হয়। তার মানসিক বিকাশ ঘটে মোবাইলের মাধ্যমে। অভিভাবক বা শিক্ষকদের মাধ্যমে নয়।
ফলে নতুন প্রজন্ম ভিড়ের মধ্যে থাকলেও একাকী বোধ করে। মনের কথা অভিভাবকদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারে না। ঘরে থাকলে মোবাইল তার একমাত্র সঙ্গী হয়। অভিভাবকরা সময় দেন না। এক বালিশে মাথা দিয়ে মা ঘুমিয়ে থাকলেও সন্তানের মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করেন না। অভিভাবকদের সঙ্গে সন্তানের মনের দূরত্ব কয়েক হাজার কিলোমিটার হয়ে যায়। বাইরে থেকে টের পাওয়া যায় না।
ক্রান্তির ছাত্রটি সুইসাইড নোটে লিখেছিল, পৃথিবীতে তার জীবনের কোনও মূল্য নেই। সে ভালো ছাত্র হতে পারেনি, ভালো বন্ধু হতে পারেনি, ভালো দাদা হতে পারেনি। কারও যখন মনে হয়, তার জীবনের মূল্য নেই, তখন ডিপ্রেশন বা অবসাদ কোন স্তরে পৌঁছেছে, তা বোঝাই যায়। অবসাদ চরমে উঠলে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আত্মহত্যার জন্য তার কাছে কারণের অভাব হয় না। তুচ্ছ ব্যাপারও তার কাছে বড় হয়ে ওঠে।
অথচ কারও জীবনই মূল্যহীন নয়। এই উপলব্ধির বীজ ছোট থেকে সন্তানের মনে বপন করার প্রথম দায়িত্ব অভিভাবকদের। সোজা কথায়, অভিভাবককে সন্তানের মন পড়তে, জানতে হবে। প্রতিনিয়ত খেয়াল রাখতে হবে সন্তানের আচার-আচরণে কোনওরকম অসংগতি দেখা যাচ্ছে কি না। দেখা গেলে, সঙ্গে সঙ্গে নজর দিতে হবে, প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে হবে।
অবসাদকে জিইয়ে না রেখে কাউন্সেলিং করা দরকার। মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিত্সা প্রয়োজন। ডিপ্রেশনের কথা উঠলে অনেকে ভাবেন মাথা খারাপ হয়েছে। একদমই না। সঠিক চিকিত্সককে দিয়ে কাউন্সেলিং করালে যে কেউ সুস্থ হতে বাধ্য। এর কোনও বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে, জীবন একটাই। তাই নিজেকে হত্যা না করে এই জীবনেই ফিরুক বাঁচার আনন্দ।