- আশিস ঘোষ
প্রায় দুই দশক আগেকার কথা। নন্দীগ্রাম তখন জ্বলছে। গোটা এলাকায় সিপিএম দূরস্থান, পুলিশ, প্রশাসনের কেউ পা রাখতে পারছে না। দিনের পর দিন। ইন্দোনেশিয়ার সালেমদের সঙ্গে নিয়ে নন্দীগ্রামে কেমিক্যাল হাব হবে, এটা চাউর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠেছিল পূর্ব মেদিনীপুরের এই এলাকা। তেমন একটা নোটিশও দেওয়া হয়েছিল। তাতে কোন কোন মৌজা সরকার নিয়ে নেবে ফলাও করে তা লেখা ছিল। জমি হারানোর ভয়ে লক্ষ্মণ শেঠের খাসতালুকে যে এমন গণবিদ্রোহ হতে পারে তা ভাবতেও পারেননি দশকের পর দশক রাইটার্সে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকা বামকুলরত্নেরা।
অবস্থা তখন এমন, দীর্ঘদিনের সখা বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরাও নিন্দায় মুখর। অবস্থা যে সত্যিই হাতের বাইরে, সেটাও অনেক বাম নেতা ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেননি। দলের পলিটব্যুরো থেকে কেন্দ্রীয় কমিটি রাজ্যের উপর খড়্গহস্ত। সেই অবস্থায় ‘আমরা ২৩৫’ বলে বারংবার হুমকি দিয়েও কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছে না নন্দীগ্রামকে। বাধ্য হয়েই সিপিএমের নেতাদের নামতে হয়েছিল ড্যামেজ কন্ট্রোলে। খেজুরিতে গিয়ে পাট্টা বিলি করতে হয়েছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে। বলতে হয়েছিল ভুল হয়েছে। অনেক কিছু বলে চেষ্টা করা হয়েছিল ক্ষত মেরামতের। কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছিল। ড্যামেজ কন্ট্রোল করা যায়নি।
অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস আর সবাইকে তাচ্ছিল্য করার অহংকার ডুবিয়ে দিয়েছিল সর্বশক্তিমান সিপিএমকে। আজও সেই ধাক্কা সামলাতে পারেনি তারা। ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে নানা কায়দা কৌশল করেও চিঁড়ে ভেজানো যায়নি। সিবিআই তদন্ত ঠেকাতে পুলিশ প্রশাসনকে ম্যানেজ করা, পার্টির ভিনরাজ্যের কমরেডদের ম্যানেজ করা, বামফ্রন্টের শরিকদের ম্যানেজ করা, বুদ্ধিজীবীদের থেকে পাবলিককে ম্যানেজ করতে বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। কিন্তু সেই ম্যানেজমেন্টে তারা যে ডাহা ফেল করেছিল তা তো দেখাই গেল। কারণ যাদের জন্য এত আয়োজন সেই সাধারণ মানুষের কাছেই বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছিল তারা। পরে ভুল হয়েছে, আর হবে না বারবার বললেও প্রলেপ পড়েনি ক্ষতে।
রাজনীতিতে এমন ড্যামেজ কন্ট্রোলের প্রয়োজন অনেক সময়েই হতে পারে। এটা নতুন কিছু কৌশল নয়। কিন্তু কন্ট্রোল করার আগে তো কবুল করতে হবে ড্যামেজটা হয়েছে। বেশ বড় মাপের ক্ষতি। ড্যামেজ হলে তবেই তো তার মেরামতির প্রশ্ন আসে। কথা হল, ড্যামেজটা হতে পারল কেন। যাদের ওপর মানুষের ক্ষোভ চরমে তারা কী করে সন্দেশখালিতে তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারল? কাদের প্রশ্রয়ে ফুলেফেঁপে উঠতে পারল শাহজাহান অ্যান্ড কোম্পানির বেআইনি কাজকারবার। কেউ জানত না তা কি হতে পারে? তাদের কি শাস্তি হবে? জমি, পয়সা ফেরত দেওয়া যায়, সম্ভ্রম ফিরবে কোন পথে? সন্দেশখালি নন্দীগ্রাম নয় ঠিকই, কিন্তু প্রতিবাদী মানুষজন একই। একইভাবে মুখ বুজে দিনের পর দিন সহ্য করা, খেটে খাওয়া মানুষ।
এমন গাদা গাদা অস্বস্তিকর প্রশ্ন উঠে আসছে রোজই। ক্ষমতায় যারা, জবাব দেবে তারা। তার উপরে লোকসভার ভোট সামনেই। ফলে এখন যে কোনও ঘটনা, যে কোনও কথাই ইস্যু হয়ে উঠতে পারে। ভোটের ফায়দা তুলতে ময়দান ছাড়বে না কেউই। প্রতিদিন এখানে ওখানে নানা মাপের মিছিল, মিটিং হচ্ছে। দিল্লি থেকে নানারকমের কমিশন আসছে, যাচ্ছে। তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা এখন রোজই সন্দেশখালিতে গিয়ে শুনছেন মানুষের কথা। তাঁদের প্রথম প্রশ্নটাই হল, আপনারা এতদিন কোথায় ছিলেন? আগে এলে এত কিছু করার হিম্মত হত না কারও। তাঁদের তাড়ায় পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে স্থানীয় বাহুবলিদের। গ্রামের মানুষজন চান, শাহজাহানকে গ্রেপ্তার করা হোক। তার কঠিন সাজা হোক।
এ থেকে শিক্ষা নিলে আখেরে লাভ হবে শাসকদলের। না নিলে? সে দৃষ্টান্তও আছে হাতের কাছে।