রন্তিদেব সেনগুপ্ত
দাদা এলেন নয়াদিল্লি থেকে। আরামবাগে আর কৃষ্ণনগরে সভা করলেন। আবার আসবেন। আবার সভা করবেন। বারবার সভা করতে দাদা নয়াদিল্লি থেকে উড়ে আসবেন এখানে। ভোটের ঢাকে কাঠি পড়ে গিয়েছে।
দিদিও চুপচাপ বসে নেই। ইতিমধ্যেই দিদি জেলায় জেলায় সভা করা শুরু করে দিয়েছেন। ১০ তারিখ ব্রিগেডে বড়সড়ো জনসমাবেশ করবেন। দাদা এবং দিদির বাজনদাররাও চুপ করে বসে নেই। দাদা-দিদিরা যত বলেন, বাজনদাররা বলে তার শতগুণ বেশি। কথাতেই আছে, বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়।
আমরা পাঁচ পাবলিক এসব কথা শুনি। শুনেই যাই। ভোটের ঢাকে কাঠি পড়লে দাদা-দিদিদের এসব কথা শুনতে শুনতে আমাদের কান ঝালাপালা হয়ে যায়। তবু এসব মন কি বাত আমাদের শুনে যেতে হয়। ভোটের ঢাকে কাঠি পড়লে আরও বেশি করে শুনতে হয়। কিন্তু আমাদের মনের বাত? সেটা কে শোনে? দাদা-দিদিদের কথা শুনলে আমাদের মনেও তো বাষ্পের মতো ভকভক করে কত কথা উঠে আসে। কিন্তু শোনে কে? দাদা-দিদিরা শোনেন না। তাঁদের শোনার অভ্যাস নেই। তাঁরা শুধু বলেন। বলেই চলেন।
এই যেমন দিল্লি থেকে দাদা এলেন, বললেন আর চলে গেলেন। দাদা আসার আগেই, আমরা পাঁচ পাবলিক জানতাম দাদা কী বলবেন। সন্দেশখালির মতো এরকম হাতে গরম ইস্যু দাদা কিছুতেই ছাড়বেন না- আমরা জানতাম। দাদা ছাড়েননি। সন্দেশখালির নারী নির্যাতনের কথা দাদা গলা কখনও উঁচুতে তুলে, কখনও খাদে নামিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে মঞ্চ থেকে তুলে ধরেছেন। এই নির্যাতনের বদলা নিতে বলেছেন বাংলার মানুষকে। বেশ করেছেন, ঠিক করেছেন বলেছেন। সন্দেশখালির ঘটনা আমাদের পাঁচ পাবলিককেও স্তম্ভিত করেছে। ঘৃণায় শিউরে উঠেছি আমরাও।
দাদা যা যা বলেছেন গুনেগুনে তার জবাব দিদি ১০ তারিখের ব্রিগেডের সভায় দেবেন-আমরা জানি। বেশ কড়া ডোজেই দেবেন। ইতিমধ্যেই অবশ্য দিদি কিছু জবাব দিয়েছেন। দিদির বাজনদাররা তাঁর থেকেও বেশি জবাব দিয়েছেন। সন্দেশখালির ঘটনার পিছনে ষড়যন্ত্র দেখতে পেয়েছেন দিদি। দিদি বলছেন, যা যা অন্যায় হয়েছে সবই তাঁর অজান্তে হয়েছে। দাদা-দিদি দুজনেই তাঁদের ভাষণে বলেছেন, কাউকে আমরা ছেড়ে কথা কইব না।
এসব শুনে আমাদের পাঁচ পাবলিকের মনে কিছু ধন্দ জেগেছে, সেই সঙ্গে কিছু প্রশ্নও। দাদা এত কিছু বললেন, কই, তিনি তো একবারের জন্যও বললেন না মণিপুরের নির্যাতিতা এবং ধর্ষিতা মহিলাদের ন্যায় পাইয়ে দেওয়ার জন্য তিনি কী করেছেন? গত এক বছরে হিংসাবিধ্বস্ত মণিপুরে নির্যাতিতা নারীদের পাশে গিয়ে তিনি দাঁড়াতে পারেননি কেন? অথচ ভোটের ঢাকে কাঠি পড়তেই তিনি দিব্যি ছুটে এসেছেন এই বাংলায়। সংসদে দাদার ঠিক পিছনের আসনটি অলংকৃত করে কেন বসে থাকেন মহিলা কুস্তিগিরদের যৌন লাঞ্ছনার ঘটনায় অভিযুক্ত ব্রিজভূষণ শরণ সিং? ঘাড় ঘুরিয়ে দাদা কি তাঁকে দেখতে পান না? বিলকিস বানোকে যারা ধর্ষণ করেছিল, সেই ধর্ষকদের গলায় মালা পরিয়ে দাদার দলের লোকেরা যখন সংবর্ধনা জানায়, দাদা তখন যোগনিদ্রায় যান কেন?
আবার দিদির কথা শুনেও আমাদের সাদা মনে কিছু প্রশ্ন জেগেছে। আচ্ছা, দিদি বলেছেন যা কিছু ঘটেছে সব তাঁর অজান্তে। গত দশ বছর ধরে সন্দেশখালিতে শেখ শাহজাহান নামক এক নিম্নশ্রেণির দুষ্কৃতী এবং তার শাগরেদরা পরের জমি গায়ের জোরে দখল করছে, চাষের জমিতে নোনা জল ঢুকিয়ে দিয়ে ভেড়ি বানাচ্ছে, মহিলাদের ওপর অত্যাচার করছে, সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছে- এসব কিছু দিদি জানতেন না? সব তাঁর অজান্তে হয়েছে? দিদি তো রাজ্যের পুলিশমন্ত্রীও। সন্দেশখালিতে এত কিছু ঘটে যাচ্ছে দশ বছর ধরে, দিদির পুলিশ কী করছিল? তারা কেন অভিযোগ গ্রহণ করেনি ওইসব অত্যাচারিত মানুষজনের? তাদের কাছ থেকে দিদি কেন কোনও খবর পাননি?
দিদি তো প্রায়শই গর্ব করে বলে থাকেন এই বাংলায় কোথায় কী ঘটছে, কে কী করছে সব তাঁর নজরে রয়েছে। কলকাতা থেকে মাত্র পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরের সন্দেশখালিই শুধু তাঁর নজরের বাইরে থেকে গেল?
দাদা বলেছেন তিনি দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেন না। দাদার একটি প্রিয় স্লোগান- না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা। দাদা এ-ও বলেছেন কোনও দুর্নীতিবাজকে তিনি ছাড়বেন না। আচ্ছা, দাদা কি এটা জানেন, হিমন্ত বিশ্বশর্মা, অজিত পাওয়ার, শুভেন্দু অধিকারী এবং এরকম আরও অনেকে, যাঁদের বিরুদ্ধে একসময় দুর্নীতির অভিযোগে সরব হয়েছিল বিজেপিই, তাঁরাই আজ বিজেপিতে নিশ্চিন্তে ঘরকন্না করছেন। তাঁদের দলের আর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছে বিজেপি।
দাদা কি জানেন, তাঁর দলটিকে পাঁচ পাবলিক এখন ‘ওয়াশিং মেশিন’ বলে ডাকছে। দাদা বোধহয় ভুলে গিয়েছেন, তাঁর দলের সরকারের আমলেই মধ্যপ্রদেশে ব্যাপম কেলেঙ্কারি ঘটেছিল। উত্তরপ্রদেশে তাঁরই দলের পোস্টারবয় যোগী আদিত্যনাথের সরকারের বিরুদ্ধে অসংখ্য ভুয়ো জব কার্ডের অভিযোগ উঠেছে। কর্ণাটকে যখন তাঁর দল সরকারে ছিল, সেই সরকারটিকে কাটমানির সরকার বলে ডাকত লোকে। সিএজি রিপোর্টে দাদার সাধের কেন্দ্র সরকারের কয়েকটি দপ্তরে আর্থিক অনিয়ম এবং দুর্নীতির উল্লেখ করা হয়েছে। দাদা কি এটা বলবেন পিএম কেয়ার্স ফান্ডের হিসাব কেন আমাদের জানানো হয় না? ওটা তো আমাদের, মানে পাঁচ পাবলিকের টাকা।
এবার ধরুন দিদির কথা। দাদার মতো দিদিও বলেছেন, তিনি কখনও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেন না। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তিনি কঠোর। অথচ কী আশ্চর্য, সেই দিদির আমলেই সারদা কেলেঙ্কারি ঘটে গেল। সেই কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হয়ে দিদির দলের নেতারা ভুবনেশ্বরে জেল খেটে এলেন। এই জেল খাটা নেতারা জামিনে ছাড়া পেয়ে আবার দিদির দয়াতেই এমপি-এমএলএ হয়ে গেলেন। এই দিদির সরকারেরই মন্ত্রী, এমএলএ, নেতারা দুর্নীতির দায়ে এখন জেল খাটছেন। নিত্যদিন একটি করে নতুন দুর্নীতির কথা শুনতে পাচ্ছি আমরা। নেতা-মন্ত্রীদের ঘর থেকে কেমন কোটি কোটি কালো টাকা উদ্ধার হচ্ছে তা-ও দেখছি। জানতেন না দিদি এসব? জানতেন না তাঁর দল এবং সরকারের অন্দরে কী ভয়ানক দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে? এখন যদি দিদি বলেন আমি জানতাম না, তখন আমরা পাঁচ পাবলিক বলব দিদি তাহলে দল এবং সরকার কোনওটিরই পরিচালনার যোগ্য নন। আর যদি যোগ্য প্রশাসকই হন দুর্নীতি রোধে তিনি কঠোর হতে পারেননি কেন?
দাদা-দিদি দুজনেই বলেছেন, তাঁরা কোনও কিছুতেই ভয় পান না। কিন্তু আমরা পাঁচ পাবলিক আসলে জানি দাদা-দিদি দুজনেই বেজায় ভীতু। দুজনেই আয়নার সামনে দাঁড়াতে ভয় পান। ভয় পান আয়নায় নিজেদের মুখ দেখতে। আমাদের পাঁচ পাবলিকের মনের ভোটে দাদা-দিদি দুজনেই হেরে গিয়েছেন। দুয়ো, দুয়ো, দুয়ো।