Thursday, May 16, 2024
Homeকলামআর দাসত্ব নয়, আসুন নেতাদের প্রশ্ন করি

আর দাসত্ব নয়, আসুন নেতাদের প্রশ্ন করি

  • শুভঙ্কর চক্রবর্তী

আচ্ছা, আপনার পাড়ায় বা পরিচিতদের মধ্যে কতজন নেতা বা ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা সম্পর্কে জানেন? তাঁরা ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবস পালনের কারণ জানেন সবাই? ভোট চাইতে বাড়িতে এলে যদি নেতাদের জিজ্ঞাসা করেন, দ্বিতীয় পানিপতের যুদ্ধ কবে এবং কাদের মধ্যে হয়েছিল, তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। কিংবা ধরুন, আপনার গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্য বা প্রধানের কাছে আমের বিজ্ঞানসম্মত নাম জানতে চাইলেন।

পঞ্চায়েত আইনে গ্রামসভার জন্য কী বলা আছে, জিজ্ঞাসা করলেন পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি বা জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষকে। পুর আইনের ধারা, উপধারা পড়ে দেখেছেন কি না কৌতূহল দেখালেন পুরসভার চেয়ারম্যানের কাছে। পাড়ার শনিপুজোয় ১০ টাকা চাঁদা দেওয়ার আগে আমরা চারবার জিজ্ঞাসা করি প্রসাদে শিন্নি থাকবে না খিচুড়ি। খিচুড়ি হলে সঙ্গে ঘ্যাঁট থাকবে না পনির তরকারি। তাহলে দেশের, নিদেনপক্ষে গ্রাম বা শহরের দায়িত্ব যাঁদের হাতে তুলে দিচ্ছি, তাঁদের একবার যাচাই করে নিতে দোষ কোথায়?

দিনভর আমরা অনেকে নিজেদের মধ্যে আলোচনায় নেতাদের বাপবাপান্ত করি। কথায় কথায় চোর, জোচ্চর বলে গালি দিই। অথচ সাধারণ নাগরিক হিসাবে, ভোটার হিসাবে যেসব প্রশ্ন তোলা উচিত, তার ধারেকাছে যাই না। বরং নেতাদের সিদ্ধান্ত চুপচাপ মাথা পেতে নিই। দিনের শেষে পাঁঠার ঠ্যাং চিবোতে চিবোতে বলি, ‘আমরা সাধারণ মানুষ। আমাদের কথা কে শোনে।’ কিন্তু ‘সাধারণ’ থেকে ‘অসাধারণ’ হওয়ার চেষ্টা করি না আমরাই।

১৮৪৩ সালে আইন করে ভারতে দাসপ্রথা বিলোপ করা হয়েছিল। বাস্তবে দাসত্বের রক্ত এখনও আমাদের শিরায় বইছে৷ তাই নেতাদের প্রভু মেনে আজও স্বেচ্ছায় ক্রীতদাসের ভূমিকা পালন করে চলছি আমরা। আগে দাসদের বাজারে বিক্রি করা হত। এখন ব্যক্তি নয়, বিক্রি হয় তাঁর ভোট। তফাত এটুকুই।

বুকে হাত রেখে বলুন তো, কোচবিহার থেকে গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশনের নেতা নগেন রায়কে রাজ্যসভার সাংসদ করে পাঠিয়ে কার কী লাভ হয়েছে? শপথবাক্য পাঠ করতে গিয়ে ওঁর ল্যাজেগোবরে দশা সামাজিক মাধ্যমে সবাই দেখেছেন। আইন তৈরি, সংবিধান সংশোধন, বাজেট ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। অথচ তিনি লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রতিনিধি।

জন বারলার কথায় আসি। পাঁচ বছরে একদিনের জন্যও কি ওঁকে সংসদে দেশের দূরে থাক, নিজের এলাকার বড় কোনও বিষয়ে বক্তৃতা করতে শুনেছেন? মন্ত্রী বা সাংসদ হিসাবে ওঁর এমন একটি কাজ মনে করতে পারেন, যার জন্য বারলাকে মনে রাখা যায়? দুটি মন্ত্রকের মন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিকের পারফরমেন্সের সবথেকে বড় উদাহরণ নিউ কোচবিহারে স্পোর্টস হাব। অথচ সেখানে সীমানা প্রাচীর ছাড়া আর কিছু হয়নি।

ভিভিআইপি খাতিরে কাশ্মীর থেকে রাজস্থান ঘুরে, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছবি তুলে আর মাঝেমধ্যে কোচবিহারে এসে মারদাঙ্গায় জড়িয়ে পাঁচটি বছর দিব্যি কাটিয়ে দিলেন নিশীথ। জনগণের ঝুলিতে থাকল কাঁচকলা। দেবশ্রী চৌধুরী, খগেন মুর্মুরা সাংসদ হিসাবে কোন উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন, কেউ জানেন না। সুনীল মণ্ডল, মিমি চক্রবর্তী, দীপক অধিকারী, নুসরত জাহানদের কেন সাংসদ করা হয়েছে, কেউ কি বলতে পারেন?

পারি না। কারণ, আমরা যাচাই করি না। আমাদের শরীরে যে ক্রীতদাসের রক্ত। কে সৎ আর কে চোর, সেটা কারও অজানা নয়। কোন নেতা কীভাবে মানুষের ক্ষতি করছেন, তা এখন কাউকে বুঝিয়ে দিতে হয় না। তবুও আমরা প্রশ্ন করার সাহস দেখাই না। উচ্চমাধ্যমিকে ফেল করে আন্দোলনে নামা ছাত্রীকে ট্রোল করতে করতে আমরা মেরে ফেলতে পারি। ‘আমব্রেলা’ বানান বলতে না পারায় আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় বিচারসভা বসাই। না বুঝে সরল মনে ইংরেজি, বাংলায় মেসেজ করার কথা বলা কাকিমার ভিডিও ভাইরাল করি। সেসব শুনে ‘শিক্ষিত সমাজ’ লজ্জায় মাথা হেঁট করে। অথচ আমরা দু’দিন আগে চোলাই বেচা, গোরু পাচারকারী অাকাট মূর্খকে জনপ্রতিনিধি বানাই।

সেটা আমাদের কাছে গর্বের হয়ে ওঠে। কারণ, আমরা কেউ দাদার অনুগামী, কেউ দিদির। দু’দিন আগে যে নেতার নুন আনতে পান্তা ফুরোত, তিনি অট্টালিকা হাঁকিয়ে বড় গাড়ি চড়ে, গলায় মোটা সোনার চেন, হাতে বালা পরে ঘুরে বেড়ালেও আমরা প্রশ্ন তুলি না। কারণ, আমরা দাসত্ব ভালোবাসি। কথায় আছে, মৌন থাকা সম্মতির লক্ষণ। আমাদের মৌনব্রতকে রাজনৈতিক দলগুলি সম্মতি ধরে নিয়ে যা ইচ্ছে করে যায়। এ ক্ষেত্রে সব দলের চরিত্র এক।

অধিকার ও কর্তব্য পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। জনগণ বা ভোটার প্রশ্ন করার সাহস না দেখালে, জবাব না চাইতে পারলে কিংবা হাজার টাকা ভাতা, এক বস্তা চাল বা এক বোতল মদের বদলে নিজের ভোট বিক্রি করলে কিংবা সব জেনেও নীরব থাকলে নেতারা যা খুশি করার লাইসেন্স পেয়ে যাবেনই। আমরা তাঁদের অন্যায় করার সুযোগ দিই বলে তাঁরা অন্যায় করতে পারেন। তাই সবার আগে আয়নায় আমাদের নিজের মুখ ভালো করে দেখা উচিত। সাহস করে ভোট চাইতে আসা নেতাদের প্রশ্ন করা উচিত। ভোটারদের প্রশ্নেই ঝরে পড়তে পারে দীর্ঘদিনের জমে থাকা মরচে, খুলে যেতে পারে দাসত্বের তালা।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Abhijit Ganguli | মমতাকে নিয়ে ফের ‘কুকথা’ অভিজিতের! নির্বাচন কমিশনে তৃণমূল

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: বিচারপতির চেয়ার ছেড়ে জনতার দরবারে হাজির হয়েছেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Bjp candidate Abhijit Ganguli)। পদ্মের প্রার্থী হয়েছেন তমলুক থেকে। রাজনীতির আঙিনায়...

Harishchandrapur | প্রাকৃতিক দুর্যোগ, হরিশ্চন্দ্রপুরে বজ্রপাতে মৃত্যু নব দম্পতি’র

0
হরিশ্চন্দ্রপুর: প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণ হারালেন এক নব দম্পতি। হরিশ্চন্দ্রপুরের (Harishchandrapur) তুলসিহাটা গ্রাম পঞ্চায়েতের কুর্সাডাঙ্গি এলাকার ঘটনা। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, মৃতরা হলেন নয়ন রায়(২৪) ও...

Malda lightning | মালদাজুড়ে বজ্রপাতে প্রাণহানি অন্তত ১১ জনের, ক্ষতিপূরণ ঘোষণা

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: মালদায় বজ্রপাতে (Malda lightning) মৃত্যু হল ১১ জনের। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে বজ্রবিদ্যুৎ...

Death at Gym | ট্রেডমিলে দৌড়োতে দৌড়োতেই লুটিয়ে পড়ল ১৭ বছরের কিশোর, পরে মৃত্যু

0
রায়পুর: ট্রেডমিলে দৌড়োতে দৌড়োতেই লুটিয়ে পড়ল কিশোর। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। ছত্তিশগড়ের রায়পুরের ঘটনা। রায়পুরের খামতারাই এলাকার...

King Cobra | দক্ষিণ ধূপঝোরায় প্রায় ১৩ ফুট লম্বা কিং কোবরা উদ্ধার

0
চালসা: প্রায় ১৩ ফুট লম্বা কিং কোবরা (King Cobra) উদ্ধার হল মেটেলি (Matelli) ব্লকের দক্ষিণ ধূপঝোরায়। বৃহস্পতিবার ঢাঙ্গাধুরা এলাকার রাব্বু আলমের বাড়ির সুপারি বাগান...

Most Popular