- আশিস ঘোষ
শূন্য প্রথম এসেছিল আর্যভট্টের মাথায়। সেই থেকেই শূন্যের বড়সড়ো একটা কাজের জায়গা আছে অঙ্কশাস্ত্রে। গণিতে শূন্য বাদ দিলে চলে না। যদিও আদতে শূন্য তো শূন্যই। তা একেবারে কিছু নয়। তার কোনও ওজন নেই। মাথার উপরে যে মহাকাশ, সেও তো মহাশূন্য। এই শূন্যের সঙ্গে যে সংখ্যারই যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ করুন না কেন, ফল হবে সেই শূন্যই।
সে তো গেল অঙ্কের কথা। রাজনীতিতে শূন্যের আবার আলাদা একটা হিসেব। সেখানে শূন্যের হিসেব আবার অন্যরকমের। যে দল ভোটে শূন্য পায় তার নম্বর একেবারেই নেই। স্কুলের ফেল করা ছাত্রের মতো মুখ লুকিয়ে ঘোরাফেরা করতে হয় তাদের। উঠতে বসতে সবাই তাদের শূন্য বলে গালমন্দ করে। অর্থাৎ ভোটের বাজারে তাদের কোনও দাম নেই।
এ রাজ্যে দুই বিরোধী দল কংগ্রেস-সিপিএম বিধানসভায় শূন্য। বিধানসভায় তাদের একজনও নেই। ফলে শাসকদল তৃণমূল উঠতে বসতে তাদের নিয়ে ঠাট্টা করে। বিরোধীদের মুখরক্ষা করেছে একমাত্র নতুন গজিয়ে ওঠা একটা দল, আইএসএফ। আর সাতাত্তরজনকে নিয়ে বিরোধীদের খালি জায়গাটা দখল করেছে দিল্লির শাসক বিজেপি। এই যখন অবস্থা তখন ভোটের মুখে দরকষাকষিতে শূন্যরা বেশ পিছিয়ে থাকবে তাতে বিচিত্র কী!
ভোটের অঙ্কে বলতে গেলে বেশ মাথা হেঁট করা পরিসংখ্যান। গত লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের ছিল ৫.৬৭ শতাংশ। সিপিএমের ছিল ৬.৩৪ শতাংশ। সেখানে তৃণমূলের ছিল ৪৩.৬৯ শতাংশ, বিজেপির ৪০.৬৪ শতাংশ। তবু তো সেবার দুটো সিট জিতে বিরোধীদের মুখরক্ষা করেছিল কংগ্রেস। বছর দুয়েক পরে বিধানসভার ভোটে কংগ্রেস পেয়েছিল ২.৯৩ শতাংশ আর সিপিএমের ৪.৭৩ শতাংশ। দুই পার্টির কেউ একটা সিটও জিততে পারেনি। বরং জামানত জব্দ হয়েছে বেশিরভাগ সিটে। সেই থেকেই শূন্যের খোঁটা। এর আগে-পরে যত ভোট হয়েছে দুই পার্টির ভোটের গ্রাফ ক্রমেই নেমেছে। বিজেপিকে হটিয়ে কিছুতেই এগোতে পারেনি তারা। কমাতে পারেনি তৃণমূলের ভোট।
এই অবস্থায় আবার লোকসভা ভোট। এ বার অনেক ঘটা করে ইন্ডিয়া জোট হয়েছিল। কিন্তু যত দিন গড়াচ্ছে ততই তার গঙ্গাযাত্রা নিশ্চিত হচ্ছে। এ রাজ্যের তিন বিজেপি বিরোধী এক টেবিলে বসে মিটিং করেছে। কাগজে টিভিতে ফলাও করে সেসব ছবি বেরিয়েছে। লোকে বিজেপির সঙ্গে একটা জব্বর লড়াই হবে ভেবে বসেছিল। হা হতোস্মি। কোথায় কী! বেলা বাড়তেই দেখা গেল কে কোথায় ছিটকে পড়ছে। পাশের রাজ্যে সুশাসনবাবু নীতীশ ডিগবাজি খেয়ে দিব্যি বিজেপির কোলে উঠে পড়েছেন। সিবিআই, ইডির জোড়া হামলায় হেমন্ত সোরেন ইতিমধ্যেই জেলে। দিল্লির কেজরিওয়াল ক’দিন বাইরে থাকবেন তা নিয়ে জোর জল্পনা। বিরোধী শিবিরকে ছত্রভঙ্গ করতে বিজেপি আদাজল খেয়ে নেমে পড়েছে।
তারই মধ্যে আরও বিচিত্র কাণ্ড এখানে। ইন্ডিয়া জোটের বড় শরিক কংগ্রেসের রাহুল গান্ধি এলেন তাঁর ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রায়। সঙ্গে সঙ্গে আমরা দেখলাম কী দ্রুততায় বদলে গেল সব পাটিগণিত। মুখে তারা ‘জোটে আছি’ বলেও পদে পদে সে যাত্রাকে যতরকমভাবে সম্ভব বাধা দিয়েছে রাজ্যের সরকার। সেই সঙ্গে বাম-কংগ্রেসের নামে তুমুল গালমন্দ। অসম থেকে এ রাজ্যে ঢোকার পর গোড়ার দিকে গাল খাচ্ছিল সিপিএম। রাহুল যাত্রা যত দক্ষিণে নেমেছে ততই সমালোচনা বেড়েছে কংগ্রেসের।
কংগ্রেসের তরফে মুখ না খুললেও গালমন্দের ঝাঁঝ কমেনি বিন্দুমাত্র। ক্রমে তা হয়েছে নিছক ব্যক্তিগত আক্রমণ। রাহুলের নাম না করে বসন্তের কোকিল বলা থেকে শুরু করে তিনি বিড়ি বাঁধতে পারেন না পর্যন্ত কী বলা হয়নি! তাঁর যাত্রা যে লোকদেখানো, ছবি তোলার জন্য, বলা হল তাও। শেষপর্যন্ত কংগ্রেস চল্লিশটাও পাবে কি না তা নিয়ে ভরা সভায় সন্দেহ জানিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। সত্যি বলতে বিজেপির রাহুলকে আক্রমণের সঙ্গে খুব একটা তফাত ছিল কি?
কথা হল, রাজনীতিতে শূন্য সত্যিই এত হেলাফেলার হলে এক দশক ধরে রাজ্য চালিয়ে আসা একটা দলের এত উদ্বেগ কেন বোঝা মুশকিল। শূন্য দুই দল যে হিন্দু এবং মুসলিম ভোটে ভাগ বসাতে চাইছে তা নেত্রী নিজেই জানিয়ে দিয়েছেন। সিপিএমের সঙ্গে তো বটেই, কংগ্রেসের সঙ্গেও যে কোনও সমঝোতা হবে না তাও খোলসা করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।৷ এখানে সব আসনেই লড়বে জোড়াফুল। তার উপরে এখন এসেছে ছোট ছোট আঞ্চলিক দলের সঙ্গে আলাদা জোটের থিয়োরি। শূন্যের সঙ্গে শূন্যের যোগফল সবসময় শূন্যই না হতেও পারে রাজনীতিতে। রাম মন্দিরের হাওয়ায় ফুলেফেঁপে ওঠা পদ্ম শিবিরের সঙ্গে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা কখন যে কী সমীকরণ সামনে আনে কে বলতে পারে।