- পার্থ চৌধুরী
ছোটবেলায় স্কুল জীবনে, একান্ত ব্যক্তিগত জীবন বলে কোনও ধারণা আমাদের ছিল না। বাড়িতে একান্নবর্তী পরিবার, পাড়ায় পড়শিদের প্রাত্যহিক নিবিড় সান্নিধ্য, স্কুলে সহপাঠীদের সঙ্গে হুটোপাটি, কখনও একক অস্তিত্বর কথা মনে হওয়াকে ঠাঁই দিত না সে সময়। তবে পরীক্ষায় নম্বর কম পেলে, ক্লাসে মাস্টারমশাইয়ের হাতে মার খাওয়ার সময় বা অন্ধকার রাতে কারও বাড়িতে একা যাওয়ার জরুরি প্রয়োজনে একলা হতে হত কখনো-কখনো। সেগুলো অবশ্য ধর্তব্যে আসত না আমাদের কারও কাছেই।
এই আবহেই একটু গরম পড়া কোনও দিনে মাদুর নিয়ে রাতে একা ছাদে শুয়ে যখন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, ব্যতিক্রমী এক একাকিত্বের সন্ধান পেতাম। অজস্র তারাভরা আকাশ বাঙ্ময় হয়ে ধরা দিত মগজে। এসব চাক্ষুষ করতে করতে মনে হত, এতবড় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আমার অস্তিত্ব কতটুকু? আদৌ আমি আছি কি? যদি থেকে থাকি, তাহলে কেন আছি?
আজ এসব কথা ভাবতে বসলে, ছেলেমানুষি স্মরণ করে হাসি পায়। আবার মনে হয়, এগুলো কি নিছক ছেলেমানুষি নাকি মস্তিষ্ক গঠনের অনুঘটক?
মনে পড়ে স্কুল জীবনের শেষের দিকে এবং কলেজ জীবনজুড়ে শ্মশানযাত্রী হওয়া ছিল আমাদের অবশ্যকর্ম। বন্ধুদের মধ্যে কে কতবার মড়া পুড়িয়েছে তার হিসেব থাকত করের ডগায়। কোনও অজ্ঞাত কারণে কেন যেন সবার টার্গেট ছিল একশো আট। তাতে কোন স্বপ্নপূরণ হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থাকত না।
আজও মনে পড়ে কোনও কোনওদিন শ্মশানে আলাদা বসে জ্বলন্ত চিতার দিকে তাকিয়ে হাহাকারের অস্তিত্ব টের পেতাম বুকের গভীরে। ভেতরের হুহু রবে কী যখন ঘটতে থাকত মাথায়। রাগ-হিংসা-লোভ সব এক ফুৎকারে উড়ে যেত চিতার লেলিহান অগ্নিশিখার সঙ্গী হয়ে।
পাড়ায় বন্ধুর বাবা হাসপাতালে। এখন-তখন অবস্থা, রাত জাগতে হবে, কুছ পরোয়া নেই, হাজির আমরা জনা সাত-আট। ডাক্তারকে ইমার্জেন্সি কল দেওয়া থেকে জরুরি প্রয়োজনে ওষুধ আনা সব সামলে দিতাম আমরা, পাড়ার ছেলেরা। অথবা পরিচিত কারও বাড়িতে বিয়ে বা অন্য কোনও অনুষ্ঠানে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন চলছে, খাটাখাটনি সহ পরিবেশনের দায়িত্ব আমাদের। হইহই করে সব কাজ সেরে পুরস্কার হিসাবে নতুন গামছা নিয়ে বাড়ি ফিরতাম।
আচ্ছা, কেন করতাম এসব? আসলে অন্তর্গত সমূহ চেতনায় তাড়িত ছিল সমাজ, তাই যূথবদ্ধ কাজ করাতেই ছিল মুক্তির আনন্দ।
ওপরের কথাগুলো পঞ্চাশ বছর আগেকার। আজকের প্রজন্মের কাছে এসব বোকা বোকা মনে হবে। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা অনেক বেশি স্মার্ট অ্যান্ড শার্প। যূথবদ্ধ কাজেই তারাও বিশ্বাসী যেখানে তাদের স্বার্থ জড়িত। তফাত, বন্ধুরা মিলে হ্যাংআউটে গেলেও নিজের নিজের খাবারের দাম তারা শেয়ার করে। অথবা কোনও বন্ধুর বিষয়ে খোঁজ নিতে গেলে জানা যায় অনেকদিন কোনও খোঁজ রাখে না সে। দেখেশুনে আগামী পৃথিবীর মানুষের কথা ভেবে কষ্ট হয়। মনে প্রশ্ন জাগে, আমরাই কি দায়িত্ব পালনে ভুল করলাম? আজ বুঝতে পারছি নিঃসঙ্গতার করাল গ্রাসে আগামীতে কী পরিমাণ যন্ত্রণাদগ্ধ হতে চলেছে আমাদের উত্তরসূরিরা।
(লেখক নাট্যকর্মী। শিলিগুড়ির বাসিন্দা)