- পূর্বা সেনগুপ্ত
ধর্ম সমাজকে প্রভাবিত করেছে সঠিক পথে, নাকি ধর্ম-ই মানবিক বিচ্ছেদের মূল কারণ এ নিয়ে দ্বন্দ্ব চিরকালের। ঊনবিংশ শতাব্দীতে রাণী রাসমণি নির্মিত কালীবাড়িতে এই ‘ধর্ম’ বা ‘আধ্যাত্মিকতা’ নিয়েই গবেষণা করেছিলেন কামারপুকুর নিবাসী শ্রীগদাধর চট্টোপাধ্যায়। ভারতের মূল ধর্মভাবের সঙ্গে তিনি পৃথিবীর যাবতীয় ধর্মগুলিকে সাধন করে একটি সিদ্ধান্ত প্রদান করেছিলেন। এই সিদ্ধান্ত বিশ্ববাসীকে জানিয়েছিল, ‘মত পথ’! অনেক মতের অস্তিত্ব লক্ষ্যের মধ্যে ভিন্নতা ঘটায় না। অনেক পথ দিয়ে আমরা এক লক্ষ্যে গিয়ে পৌঁছাই। এক-কেই লাভ করি। ভগিনী নিবেদিতা এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘তিনি প্রত্যেক মানুষকে নিজের ভাষায় কথা বলার, ধর্মজীবন যাপন করার অধিকার দিয়ে একটি নবীন পথ সৃষ্টি করেছিলেন।’
প্রত্যেকেই নিজের পথে এগোবে, কিন্তু মনের মধ্যে কূপমণ্ডূকতা রাখবে না। নিজের মত আর পথকে নিয়ে বিদ্বেষ তৈরিতে খুব আপত্তি ছিল শ্রীরামকৃষ্ণের। যাঁরা তাঁর কাছে আসতেন, তাঁদেরকেও এই একই সহনীয়তার শিক্ষা দিতেন শ্রীরামকৃষ্ণ। কিন্তু সে শিক্ষা ছিল প্রেমময়, আনন্দময়। কী অসাধারণ ভালোবাসা দিয়ে তিনি যুবকদের, তাঁর ভাবী বার্তাবাহকদের মনকে সুসিক্ত করেছিলেন তা আজও ভাবতে শিহরণ লাগে। সকলেই মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন, ঈশ্বর স্বয়ং প্রেমস্বরূপ। বিচিত্র ও বহুমুখী ছিল তাঁর ভালোবাসাময় শিক্ষার অভিমুখ। যার যেখানে শিক্ষার দরকার তাকে সেই বিষয়টিই ধরিয়ে দিতেন।
স্বামী অখণ্ডানন্দ বা কিশোর গঙ্গাধর উপস্থিত হয়েছেন। ছোট থেকেই বিষম আচারপ্রিয়। হরীতকী খেলে ইন্দ্রিয় সংযত হয়, তাই হরীতকী খেয়ে খেয়ে ঠোঁট সাদা করে ফেলেছেন। আহার হবিষ্যান্ন। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর আচার ব্যবহার দেখে বেশ বিরক্ত হলেন। এই জগৎ-জীবন তো তাঁরই সৃষ্টি! তাহলে ঈশ্বরকে লাভ করতে এত রংহীন পথে যাত্রা করা কেন? তাই একদিন গঙ্গাধর বকুনি খেলেন তাঁর কাছে, ‘এই তুই এত বুড়োটে কেন?’ যা কালীঘরের প্রসাদ পেয়ে আয়।’ গঙ্গাজলে রান্না মায়ের ভোগ। তবু গঙ্গাধরের মন খুঁতখুঁত করে। তিনি এগোতে থাকেন কিন্তু মন এগিয়ে চলে না। পিছন ফিরে দেখেন, শ্রীরামকৃষ্ণ দরজায় দাঁড়িয়ে দেখছেন তিনি কালীঘরের প্রসাদ গ্রহণ করতে সত্যই গেলেন কি না। এ প্রসঙ্গে তাঁর কাছে উদাহরণ ছিলেন সিমলের ছেলে নরেন্দ্রনাথ। সকল যুবকভক্তদের তিনি নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপ করতে আদেশ ও উৎসাহ দিতেন। নরেন কেমন খাপ খোলা তরোয়ালের মতো ঘুরে বেড়ায়। দোকানের অখাদ্য অর্থাৎ মাংস জাতীয় কিছু খেয়ে এসে নির্ভয়ে গুরুকে বলেন, ‘আজ অখাদ্য খেয়ে এসেছি মশাই!’ সকলে জানলে নরেন আজ কুক্কুটের মাংস খেয়ে দক্ষিণেশ্বরে এসেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সকলকে বলেন, নরেনের মধ্যে আগুন জ্বলছে, ওসবে কিছু ক্ষতি করতে পারবে না। স্পর্শদোষ জনিত কোনও খাবার তিনি স্বয়ং গ্রহণ না করতে পারলে, অন্য যুবকদের তা দিতে বারণ করলেও সেই খাবার তুলে রাখতেন নরেন্দ্রনাথের জন্য। জানতেন সেই-ই বিষ হজম করতে পারবে।
কারণ, নীলকণ্ঠ শিবের অবতার সে যে! তাঁর সঙ্গী, প্রচারক। যুগধর্ম জগতের কাছে পৌঁছে দেবে মহানিষ্ঠায়। পরবর্তীকালে শ্রীমা সারদাদেবী এক ভক্ত বধূকে জিজ্ঞাসা করছেন, ‘আচ্ছা, নরেন দক্ষিণেশ্বরে মাংস চিরে চিরে কি যেন রান্না করত! সে কী রান্না মা?’ ভক্তমহিলা উত্তর দিলেন, ‘বোধহয় চপ-কাটলেট হবে’। যে দক্ষিণেশ্বরে পঞ্চবটীর তলায় শ্রীরামকৃষ্ণ ভৈরবী ব্রাহ্মণীকে গুরু করে চৌষট্টি তন্ত্রের সাধন করেছিলেন। তোতাপুরীর কাছে অদ্বৈত সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, সেই পবিত্র ভূমিতে বসে যুবক সন্ন্যাসীর দল চড়ুইভাতিতে মেতেছেন। নেতা নরেন্দ্রনাথ দত্ত, মেনু চপ-কাটলেট। এখনও অনেক তথাকথিত ধর্মপ্রাণদের মানতে কষ্ট হবে। বাড়িতে বাবুর্চি রেখে দুইবেলা মোঘলাই খানার বন্দোবস্ত হত। বিশ্বনাথ দত্তের ছেলেরা স্কুল থেকে ফিরে খেতেন মটরশুঁটি দিয়ে পাঁঠার মুড়ির তরকারি। তাতে নাকি বুদ্ধি বৃদ্ধি হয়। তাই দক্ষিণেশ্বরে চড়ুইভাতিতে চপ-কাটলেট খাওয়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা।
শ্রীরামকৃষ্ণের দেহরক্ষার পর একবার বরাহনগর মঠে শিবরাত্রি পালিত হচ্ছে। স্বামী সারদানন্দ, শ্রীরামকৃষ্ণের আদরের শরৎ হঠাৎ উপবাসী সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘দেখ শিবরাত্রির দিন নির্জলা উপবাস করলেও আমরা চা খেতে পারি!’ কথা শুনে শ্রোতা মহেন্দ্রনাথ দত্ত অবাক! সে কীরকম? স্বামী সারদানন্দ উত্তর দিলেন, ‘যেদিন ঠাকুরের শরীর চলে গেল, সেদিন কারও খাওয়ার কথা মাথায় এল না। কে উনুন ধরাবে, কে রান্না করবে! সকলেই শোকে নিমগ্ন। সব শেষ হলে স্বামীজি বললেন, চা কর। কাঠ-কুটো জ্বেলে চা করা হল। সকলে ঢোক ঢোক করে সেই চা, খেলাম অমন বিষাদের দিনে যখন চা খাওয়া হয়েছিল। তাহলে শিবরাত্রির দিন খেলে আর কী হবে!’
বিস্মিত মহেন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের মধ্যে, অর্থাৎ বরাহনগর মঠে কে চা খাওয়াটি ঢোকালে? শরৎ মহারাজ উত্তর দিয়েছিলেন, ‘কেন তোমাদের বাড়িতে যে চা খাওয়ার অভ্যেস ছিল, নরেন সেটাই মঠে ঢোকালে।’ স্মরণে রাখা দরকার যে, চা তখন খুব চালু পানীয় ছিল না। ঘরে ঘরে আপ্যায়নের জন্য চা তৈরি থাকত না। সেই যুগেই শ্রীরামকৃষ্ণ শিষ্য, মাথার মণি নরেন্দ্রনাথ এমন সব অভ্যেসকে এবং আচারকে সন্ন্যাসী সংঘভুক্ত করেছিলেন। বোহেমিয়ান নরেনকে অজস্র ভালোবাসায়, প্রশ্রয়ে ধারণ করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। কারণ তিনি যে উদার ধর্মভাবনাকে প্রতিষ্ঠা করতে চলেছেন, নরেন তাঁর সার্থক উত্তরসূরি। সকলে আপাতদৃষ্টিতে দেখতেন নরেন অনবরত শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে তর্ক করে চলেছেন। নানা বিষয়ে মতবিরোধকে অনায়াসে স্থাপন করছে তাঁর সম্মুখে। কিন্তু এই তর্কের পিছনে যে গ্রহণের প্রক্রিয়াটি ছিল তা সকলের চোখে ধরা পড়ত না।
বৈষ্ণব শাস্ত্রের বিষয়ে বলতে গিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ একদিন ভক্তদের বলছেন, ‘জীবে দয়া, নামে রুচি আর বৈষ্ণব সেবন- এই হল প্রধান উপায়।’ কিন্তু বলার পরে ভাবস্থ হলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। সেই অন্তস্থ অবস্থায় বলে উঠলেন, ‘জীবে দয়া? তুই কীটাণুকীট তুই কাকে দয়া করতে পারিস? বল শিব জ্ঞানে জীব সেবা!’ সেদিন সেই ছোট্ট ঘরে অনেক ভক্তই বসে ছিলেন। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের কথার গুরুত্ব তাঁরা উপলব্ধি করতে পারলেন না। শুধু নরেন্দ্রনাথ সেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, ‘আজ আমি এক নতুন আলোক পেলাম। ভগবান যদি দিন দেন তবে এই বার্তা আমি জগতের ঘরে ঘরে প্রচার করব।’ ভাবতনুকে স্পর্শ করাই যদি যথার্থ নৈকট্য বলে ধরা হয়। তবে নরেন্দ্রনাথ কেবল শ্রীরামকৃষ্ণের নিকটে ছিলেন না। তাঁদের ভাবময় তনু একাকার হয়ে গিয়ে একতনু সৃষ্টি করেছিল।
বুদ্ধিমান, শিক্ষিত নরেন্দ্রনাথের কথা থাক। শ্রীরামকৃষ্ণ গৃহী পার্ষদ রামচন্দ্র দত্তের গৃহপরিচারক রাখতুরাম। সংস্কারবশত শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখার পর গৃহে ফিরে যেতে মন চায় না। অবশেষে তাঁর ঠাঁই হয় শ্রীরামকৃষ্ণের চরণে। সহায়সম্বলহীন রাখতুরামকে লাটু বলে ডাকতেন রামচন্দ্র দত্ত। শ্রীরামকৃষ্ণর আদরে তা হল লেটো। একদিন শ্রীরামকৃষ্ণ খুব চিন্তিত হয়ে তাঁকে বললেন, ‘সকলে আসে পড়াশোনা জানা ছেলে বুদ্ধিমান। তুই কিছু না শিখলে ওদের সঙ্গে কথা কইবি কীভাবে!’ পরদিন থেকে শুধু অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন শ্রীরামকৃষ্ণ নিরক্ষর লাটুর শিক্ষক হলেন। তিনি যত বলেন ‘বল ক’, লাটু তাঁর আজন্মকাল লালিত স্থানগত সংস্কারবশত উত্তর দেন ‘কা’। বেশ কয়েকবার শুধরে দিয়েও যখন ঠিক হল না, তখন শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে বললেন, ‘তুই ক কে কা বলবি, তবে ক এ আকার কে কী বলবি? যা, তোর পড়াশোনা শিখে দরকার নেই।’ সেদিন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন লাটু, কিন্তু গুরুকৃপায় পণ্ডিত নরেনকেও যথাযথ উত্তর দিতে পেছুপা হতেন না। তাই নরেন তাঁর নাম রেখেছিলেন ‘লেটো নয় প্লেটো’। ধর্মের বাস আনন্দ আর ত্যাগের মধ্যে। বৃথা আচার বা রাজনীতি তাকে বিকৃত করে। শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন সেই আনন্দের খনি। ভালোবাসার বৃন্দাবন।
(লেখক প্রবন্ধকার, গবেষক)