- অলকেশ বন্দ্যোপাধ্যায়
সময়টা ১৯৪৬ সালের শেষ দিক। ‘লাঙল যার জমি তার’- তেভাগা আন্দোলনের এই স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে অবিভক্ত বাংলার আকাশ-বাতাস। মাঠের ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ পাবে কৃষক আর এক ভাগ পাবে জমির মালিক। বস্তুত, এই দাবি থেকেই আন্দোলনের সূচনা। রংপুর-কোচবিহারের পাশাপাশি আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে বর্তমান উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালিতে।
আন্দোলনের সময়সীমা মোটামুটি ১৯৪৬-১৯৪৮। বর্গা প্রথায় ভাগচাষি বা ভূমিহীন কৃষকের ভাগ্যে জুটত মাঠের ফসলের অর্ধেক বা তারও কম। অথচ উৎপাদনের ক্ষেত্রে পরিশ্রম ও বীজ পুরোটাই ছিল কৃষকের। তাই সেদিনের সন্দেশখালিতে হেমন্ত ঘোষালের নেতৃত্বে রবিরাম সর্দার, বাতাসি সর্দার, পারুল সর্দার সহ কৃষকরা এই অন্যায়ের প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন। ক্রমশ গোটা বাংলায় ছড়াতে থাকে তেভাগার আগুন। এই কৃষক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কৃষক ফ্রন্টের অল ইন্ডিয়া কৃষকসভার।
ইতিমধ্যে ১৯৪৭ সালের ৮ মার্চ সন্দেশখালির বেড়মজুর গ্রামে ঘটে যায় ভয়াবহ ঘটনা। উন্মত্ত জনতা আগুন ধরিয়ে দেয় জোতদার দেবেন্দ্রনাথ সর্দারের কাছারি বাড়িতে। পুলিশের গুলিতে নিহত হন বহু মানুষ। পাশের কলাগাছি নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয় বহু লাশ। কলাগাছি নদীর জল আর সবুজ ধানখেত লালে লাল হয়ে যায়। রক্তস্নাত হয় গ্রামের পর গ্রাম। সন্দেশখালির রামপুর, দুর্গামণ্ডপ, রাজবাড়ি, জেলিয়াখালি, তুষখালি সর্বত্র জ্বলে ওঠে বিক্ষোভের আগুন। তেভাগার শহিদদের স্মৃতিসৌধ-বেদি আজও চোখে পড়ে এইসব এলাকায়। তেভাগা আন্দোলন নিয়ে কতই না অমর সৃষ্টি রয়েছে সুরকার, গীতিকার, শিল্পী, কবি-সাহিত্যিকদের।
…হেই সামালো ধান হো/ কাস্তেটা দাও শাণ হো/ জান কবুল আর মান কবুল/ আর দেব না আর দেব না/ রক্তে বোনা ধান মোদের প্রাণ হো…
তেভাগা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা সলিল চৌধুরীর এই গান আজ ইতিহাস। তেভাগা নিয়ে আরও অনেক গানই তিনি সেসময় লিখেছিলেন। সলিল চৌধুরীর গানের মতোই চিত্রশিল্পী সোমনাথ হোড়ের ‘তেভাগার ডায়েরী’ এই আন্দোলনের একটি প্রামাণ্য দলিল। একই রকম গুরুত্বপূর্ণ পূর্ণেন্দু পত্রীর তেভাগা নিয়ে লেখা, যা ‘অন্য গ্রাম অন্য প্রাণ’ শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল তৎকালীন ‘নতুন সাহিত্য’ পত্রিকায়। তেভাগা নিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি ‘ছোট বকুলপুরের যাত্রী’ ও ‘হারানের নাতজামাই’। দুটি গল্প নিয়েই হয়েছে নাটক ও চলচ্চিত্র। এই প্রসঙ্গে অবশ্যই উল্লেখ্য কবিয়াল নিবারণ পণ্ডিতের ‘মোদের দুখের কথা কাহাকে জানাই’…
সত্যিই তা-ই। আজও সন্দেশখালির মানুষের দুঃখের কথা শোনার মতো কেউ নেই। ৭৮ বছর আগে তেভাগার সময়েও ছিল জমি থেকে উৎপন্ন ফসলের ন্যায্য আদায়ের লড়াই। আর বর্তমানের লড়াই গরিবদের বিঘের পর বিঘে কেড়ে নেওয়া জমি পুনরুদ্ধারের। সেই সঙ্গেই উঠেছে নারী নির্যাতনে অভিযুক্ত শাসকদলের নেতাদের শাস্তির দাবি।
বিক্ষোভে ফুঁসে ওঠা সন্দেশখালিকে দেখে আজ মানুষ ভুলতে বসেছে, সুন্দরবনের এই দ্বীপের একটা মধুর ইতিহাসও আছে। মানুষ এখন ভাবতেই পারে না, সন্দেশখালিরও একদিন শান্ত, সুন্দর, সরল একটা জীবন ছিল। চলে যাই পঞ্চাশ বছর আগের এক ঘটনায়।
‘কী আশায় বাঁধি খেলাঘর/ বেদনার বালুচরে’ গানের দৃশ্যের শুটিং চলছে নদীর বুকে লঞ্চের ওপর সূর্যাস্তের প্রাক্কালে। হঠাৎই ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসায় পরিচালক মাঝিকে লঞ্চ ঘোরানোর নির্দেশ দিলেন। লঞ্চের ভিতরে বসে আছেন কুশীলবরা। অন্ধকারে দেখা যায় বহু দূরের একটি আলো। মাঝিকে সেদিকেই যেতে বলা হল। গিয়ে দেখা গেল আলোটা একটা দোকানের। পরিচালক দোকানদারকে বললেন, কিছু খাবার পাওয়া যাবে? দোকানদার জানালেন, শুধু শুকনো মুড়ি মিলতে পারে। ওই দোকানিই একধামা মুড়ি নিয়ে এলেন লঞ্চে। লঞ্চে এসেই তো তাঁর চক্ষু চড়কগাছ। সামনে তিনি এ কাকে দেখছেন? এ যে স্বয়ং মহানায়ক।
লোকটি আর কিছু না বলে একটি প্রণাম ঠুকে, অপেক্ষা করতে বলে লঞ্চ থেকে নেমে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল, নদীর পাড়ে হ্যারিকেন হাতে অজস্র মানুষের ভিড়। তাঁদের আবদার, মহানায়ককে একবার সর্বসম্মুখে এসে দর্শন দিতেই হবে। তিনি অবশ্য তাঁর অনুরাগীদের নিরাশ করেননি। লঞ্চ থেকে বেরিয়ে এসে ভক্তদের দর্শন দিলেন মহানায়ক। সেই সন্ধ্যায় তাঁর সহযাত্রীরা ছিলেন শর্মিলা ঠাকুর, অনিল চট্টোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত ও পরিচালক শক্তি সামন্ত।
সেদিন নদীর পাড়ে জড়ো হওয়া মানুষের কেউ কেউ আজও আছেন সন্দেশখালিতে। এই ঘটনা সত্তরের দশকে ‘অমানুষ’ ছবির শুটিংয়ের সময়ের। শুটিং হয়েছিল ভাঙা তুষখালি গ্রামে। শুটিং চলাকালীন উত্তমকুমার থাকতেন পূর্ত দপ্তরের বাংলোয়। ছবিতে উত্তমকুমার ব্যবহৃত লঞ্চ এখনও আছে। ‘যদি হই চোরকাঁটা ওই শাড়ির ভাঁজে’ গানের শুটিং যে পুকুরপাড়ে হয়েছিল, সেই পুকুর আজও বিদ্যমান। ‘অমানুষ’ ছবির মূল কাহিনী শক্তিপদ রাজগুরুর ‘নয়া বসত’ উপন্যাসের ভিত্তিতে। বেলেঘাটার ব্যবসায়ী মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ভাঙা তুষখালিতে একটি বাড়ি ছিল ওই ব্যবসায়ীর। শক্তিপদ ছুটি কাটাতে প্রায়শই সেখানে যেতেন। পরিচালক লেখকের মাধ্যমেই বাড়িটির কথা জেনেছিলেন। সেইমতো টানা শুটিং হয়েছিল। ছবিতে বনবিবির যে মন্দির দেখা যায়, সেই মন্দির এখনও আছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের, আজকের সন্দেশখালির সঙ্গে ‘অমানুষ’ সিনেমার গল্পের অনেকাংশেই মিল। সেই অন্যায়ভাবে অপরের জমি কেড়ে নেওয়া, নারীদের হেনস্তা, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো- সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। সত্তরের দশকের উত্তম-শর্মিলা জুটির আর একটি সুপারহিট সিনেমা ‘আনন্দ আশ্রম’-এর শুটিংও এখানেই হয়েছিল। সিনেমায় মহানায়ক ব্যবহৃত কাঠের বাড়ি আজও যত্নের সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। ছবিতে দেখানো কৃষ্ণচূড়া গাছটি এখনও আছে।
উত্তমকুমারকে দেখে সন্দেশখালির মানুষ যেভাবে আপ্লুত হয়েছিলেন, বহু দশক বাদে ‘চাঁদের পাহাড়’ সিনেমার শুটিংয়ে দেবকে দেখেও মানুষ অভিভূত হয়ে পড়েন। শুটিং হয়েছিল সন্দেশখালির ন্যাজাটের দুখিরামপুর গ্রামে। বাড়িটা ছিল শ্রীপদ দাসের। উঠোনের এক প্রান্তে তুলসীতলা। অপর প্রান্তে ধানের গোলা। মাচায় ঝুলছে লাউ। ঘরের চালের মাথায় শুকোচ্ছে লংকা, বড়ি। এখনও গেলে দেখা যাবে একই দৃশ্য। এছাড়াও সন্তু মুখোপাধ্যায়-মুনমুন সেন অভিনীত ‘বান্ধবী’ সিনেমার শুটিং হয়েছিল ধামাখালিতে।
সকলেরই একটাই প্রশ্ন, সন্দেশখালি আবার কবে শান্ত হবে? এখানকার নৈসর্গিক সৌন্দর্য মানুষ আবার কবে প্রাণভরে উপভোগ করতে পারবেন? আশা রাখি, ‘আনন্দ আশ্রম’ সিনেমার সেই গানের মতো আমরাও একদিন বলতে পারব, ‘পৃথিবী বদলে গেছে, যা দেখি নতুন লাগে’…