- সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
বিচিত্র এই যন্ত্রসভ্যতা। একদিকে বাড়িয়ে চলেছে উত্তাপ, অন্যদিকে তৈরি করছে ঠান্ডিঘর। মানুষে মানুষে নতুন বিভেদ। শীতল ঘরে বড় মানুষ। মানুষ, কিন্তু জাত আলাদা। আর খেটেখাওয়া ঘর্মাক্ত মানুষ। একদল অসহিষ্ণু, অন্যদিকে সর্বংসহ। এই নিয়েই যত আন্দোলন, বিভেদ। ঠান্ডা আর ডান্ডা। উত্তাপই জীবন। শীতল ঘরের বন্দি মানুষ রেশমকীটের মতো বড় একা। নিজের ঐশ্বর্যের তন্তুতে আবদ্ধ। কোনও কবি তাদের হয়ে কথা বলবেন না, কারণ জীবন ওখানে জীবন্মৃত। বরং কবি বলবেন, ‘আমি কবি যত ইতরের/ আমি কবি ভাই কর্মের আর ঘর্মের…’। রবীন্দ্রনাথ জীবনে কর্ম আর ঘর্ম, দুটোকেই বরণ করে নিয়েছিলেন।
গ্রামের সীমানা শেষ। আদিগন্ত চষাখেত, ফুটিফাটা। ঘাসের গোছা রোদে পুড়ে ঝিরকুট। মুখ থুবড়ে পড়ে আছে চালা একপাশে। বাখারির কঙ্কাল। এই কি সেই গফুর জোলার বাড়ি! এই গ্রামের নামই কি কাশীপুর? কাহিনীর শুরু কি এইখানেই?
‘সম্মুখের দিগন্তজোড়া মাঠখানা জ্বলিয়া পুড়িয়া ফুটিফাটা হইয়া আছে, আর সেই লক্ষ ফাটল দিয়া ধরিত্রীর বুকের রক্ত নিরন্তর ধুঁয়া হইয়া উড়িয়া যাইতেছে। অগ্নিশিখার মতো তাহাদের সর্পিল ঊর্ধ্বগতির প্রতি চাহিয়া থাকিলে মাথা ঝিমঝিম করে যেন নেশা লাগে।’
গ্রীষ্মের কি নিষ্ঠুর রূপ, ‘গ্রামে যে দুই-তিনটা পুষ্করিণী আছে তাহা একেবারে শুষ্ক। শিচরণবাবুর খিড়কির পুকুরে যা একটু জল আছে, তাহা সাধারণে পায় না। অন্যান্য জলাশয়ের মাঝখানে দু-একটা গর্ত খুঁড়িয়া যাহা কিছু জল সঞ্চিত হয় তাহাতে যেমন কাড়াকাড়ি তেমনি ভিড়।’
এই ভিটেতেই গফুরের বলদ মহেশ আমিনার ঘট ভেঙে জল খাবার অপরাধে প্রাণ দিয়েছিল। গ্রীষ্ম, তুমি অপরাধী? না দারিদ্র্য অপরাধী, না কি জাত-পাত বিভাজনকারী উচ্চবর্ণের মানুষ অপরাধী! আজও কি গফুর নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে মুখ তুলে বলছে না, ‘আল্লা! আমাকে যত খুশি সাজা দিও, কিন্তু মহেশ আমার তেষ্টা নিয়ে মরেছে। তার চরে খাবার এতটুকু জমি কেউ রাখেনি। যে তোমার দেওয়া মাঠের ঘাস, তোমার দেওয়া তেষ্টার জল তাকে খেতে দেয়নি, তার কসুর তুমি কখনো মাপ করো না।’
দু’সার বাবলা গাছের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে ধোঁয়াটে পথ। অতি কাতর এক বাছুর মাতালের মতো টলতে টলতে চলেছে। ডোমপাড়ায় চ্যাটাই বুনছে দশ-বারোজন মেয়েমদ্দ। তিনটে শূকর ঘুরছে ঘোঁতঘোঁত করে। পথ বাঁক নিয়ে চলে গেছে গঙ্গার ধারে। জলে গুলেছে মধ্যদিনের সূর্য। বাতাস নেই। আকাশের নীল ঝরছে শুকনো গুঁড়োর মতো। শিবমন্দিরের লিঙ্গেশ্বর শুকিয়ে কাঠ। শুকনো বেলপাতা খসে পড়ে গেছে। কোনও মতে গোটা দুই আকন্দ ফুল পাথরের লিঙ্গের মাথায় ভারসাম্য বজায় রেখে স্থির হয়ে আছে। দেওয়ালে উৎকীর্ণ মহাবীরের মূর্তি। কালো একটা কুকুর একটু ঠান্ডার খোঁজে আশ্রয় নিয়েছে বেদির তলায়। বাঁধানো বট। ছায়া ফেলেছে তলায়। একদল মৎস্যজীবী বসে আছে। কেউ জাল বুনছে, কেউ শুধু উদাস চোখে জলের দিকে তাকিয়ে বিড়ি ফুঁকছে। জল নেমে গেছে বহু দূরে। সার সার চিৎ হয়ে আছে জেলেডিঙি। সকলেই অপেক্ষায়। হঠাৎ একজন চিৎকার করবে, জোয়ার এসেছে, নৌকো ভাসা। সে যেন এক যুদ্ধ। অলস মানুষগুলি এক ঝটকায় নিজেদের তুলে ফেলবে বটের ছায়াবেদি থেকে। ডিঙিগুলো পিছলে নেমে যাবে জলে, একেকটা কেঠো কুমিরের মতো। জোয়ারের জলে মাছ আসবে সমুদ্র থেকে।
এই কি সেই শান্ত, শীর্ণ নদী! যার ভাষা-দর্শন পাওয়া যায়, দীনেন্দ্রকুমার রায়ের রচনায় : ‘স্বল্পতোয়া ক্ষুদ্র নদীটি শৈবালাদি জলজ উদ্ভিজ্জে পরিপূর্ণ, কেবল স্নানের ঘাটটি পরিষ্কার। তীরে বালুকারাশি ভেদ করিয়া দুই-একটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঝরনা হইতে কালো বালির সঙ্গে ঝির-ঝির করিয়া অতি ঠান্ডা নির্মল জল উঠিতেছে। নদী আঁকিয়া বাঁকিয়া গ্রামের প্রান্ত দিয়া বাহিয়া চলিয়াছে। অনেক দূর হইতে তাহার তীরবর্তী বাঁশঝাড়, বটগাছ ও বাঁশ-জলের বাঁশের উচ্চ অগ্রভাগ দেখা যাইতেছে।’
সে নদীর নাম হয়তো শীলাবতী। তাতে কিছু যায় আসে না। একই দৃশ্য, ‘কলসগুলি ভালো করিয়া মাজিয়া রমণীগণ স্নানান্তে কলস ভরিয়া জল লইয়া যাইতেছে। কাহারও কলসীর মুখে পিতলের ছোট একটা তেলমাখা বাটি, তাহার উপর একটা কাঁচা আম। কলসিটি কক্ষে লইয়া তাহারা অতি কষ্টে রৌদ্রতপ্ত ধূলিবর্জিত বিজন গ্রাম্যপথ দিয়া চলিতেছে। কলসে জল ছলছল করিয়া বাজিতেছে, জলসিক্ত পদাঙ্ক দেখিতে দেখিতে মাটিতে শুকাইয়া যাইতেছে।’
এমন দৃশ্যে শিল্পী কেন প্রলুব্ধ হবেন না। একপাশে মাথায় তোয়ালে চাপা দিয়ে হাঁটুতে বোর্ড রেখে তন্ময় হয়ে আছেন শিল্পী মানিকদা। রংভরা তুলি। চোখের সামনে নিজন-বিজন গ্রীষ্মলীলা, ‘শান্ত নদীটি, পটে আঁকা ছবিটি। ঝিম ধরেছে, ঝিম ধরেছে গাছের পাতায়। পাল গুটিয়ে থমকে আছে ছোট্ট তরীটি।’ আর কোথাও কি বসে আছেন, শিল্পী হেমেন মজুমদার? সিক্তবসনা সুন্দরীর দেহপটে নিমগ্ন হয়ে! বসন্তলাল দুপুরে বাড়ির স্টুডিওতে বসে তেলরঙে আঁকবেন স্টিল লাইফ গ্রীষ্মের উপাদানে। ধবধবে সাদা আচ্ছাদনে আবৃত গোল টেবিল। একটি ফুলদানি। যত রোদ, তত সাদা, কমলা, নীল আর লাল ফুল। একটি গেলাস। ভেতরে ঠান্ডা পানীয় বাইরে জলকণা জমে শিশিরের বিন্দু। একটি দ্বিখণ্ডিত লাল তরমুজ। আড় করে রাখা ইস্পাতের ছুরি। দ্বিখণ্ডিত পেঁপে। একথোলা কালোজাম, জামরুল আর বুটিদার লিচু। কয়েকটি সিঁদুরে আম। একটা হলুদ বোলতা। পেছনে প্রায় সাদা সামান্য নীলচে একটা পর্দা। একগুচ্ছ লাল গোলাপ কোথাও রাখা যেতে পারে। গ্রীষ্মের স্থিরচিত্র সম্পূর্ণ।
আমিও গফুর জোলার মতো আকাশের দিকে মুখ তুলে বলতে পারি, ‘আল্লা, এই কংক্রিট সভ্যতার বিচার করো। যারা গ্রাম কেড়ে নিয়ে বলেছিল, শহরের সুখে তোমাকে রাখব, পিচের মসৃণ পথ, কল ঘোরালেই জল, বোতাম টিপলেই আলোর ভেলকি দেখাব, অথচ তা হল না, আমার গ্রামও গেল, শহরও গেল। আমার সেই ছবি আমি ফিরে পেতে চাই। নিয়ে যাও তোমার নগরসভ্যতা। আমার বাগান কোথায়!’ যার ‘বাহিরে রৌদ্র ঝাঁঝাঁ করিতেছে। ধূসর আকাশ হইতে সূর্যদেব জ্বালাময় কিরণ বর্ষণ করিতেছেন। এলোমেলো বাতাসে পথের ধুলা ও গাছের শুষ্কপত্র উড়িয়া যাইতেছে। রৌদ্রকাতর উত্তপ্ত প্রকৃতির নিদাঘ-ক্লান্তিতে কিছুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করিয়া একটা কোকিল এই নিদাঘ-মধ্যাহ্নে ও আম্রকুঞ্জের ঘনপল্লবদলে প্রচ্ছন্ন থাকিয়া কুহু কুহু শব্দে কুহরিয়া উঠিতেছে। গ্রাম্য বালকেরা বিশ্রামসুখ পরিত্যাগপূর্বক ছুরি ও নুন লইয়া আমবাগানে প্রবেশ করিয়াছে। কেহ কণ্টকময় বঁইচি বন ঘুরিয়া সুপক্ব কালো বঁইচি ফলের গুচ্ছ খুঁজিতে খুঁজিতে কুহুস্বরের প্রতিধ্বনি করিতেছে। কোকিল বুঝি তাহাতে অপমানিত হইয়া নীরব হইতেছে। কেহ কোন রাখালের পাঁচনখানি চাহিয়া লইয়া গাছের উচ্চশাখা হইতে কাঁচা আম পাড়িতেছে। বাগানের নিবিড়তর অংশে একটা শৃগাল উপুড় হইয়া পড়িয়া ধুঁকিতেছে এবং কোনও দিকে সামান্য একটু শব্দ হইলেই মাথা তুলিয়া উদ্যতকর্ণে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সেই দিকে চাহিয়া দেখিতেছে।’ বাগান কেটে বসত হয়েছে। ঘিচিঘিচি মানুষের খুপরি খুপরি আস্তানা। সেসবে প্রোমোটারের থাবা। যারা অতীত গুঁড়িয়ে বর্তমান তৈরি করছেন। ফলে গ্রীষ্মের শোভা গেছে। সব অলংকার অপহৃত। কষ্টটাই আছে, রোমাঞ্চটা নেই। তবু জীবন যেখানে শুরু হয়েছিল দূর অতীতে, সেখানে খাঁড়ির জলের মতো অতীতে কোথাও কোথাও রয়ে গেছে। কারও তেমন নজরে পড়েনি এখনও। ঘাপটি মেরে বসে আছে পলাতক অপরাধীর মতো। আমার অন্বেষণের শেষ নেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘নিশীথে’ গল্পে লিখেছেন, ‘আমাদের সেই বরানগরের বাড়িটি বোধকরি তুমি দেখিয়াছ। বাড়ির সামনেই বাগান এবং বাগানের সম্মুখেই গঙ্গা বহিতেছে। আমাদের শোবার ঘরের নীচেই দক্ষিণের দিকে খানিকটা জমি মেহেদির বেড়া দিয়া ঘিরিয়া আমার স্ত্রী নিজের মনের মতো একটুকরা বাগান বানাইয়াছিলেন। বেল, জুঁই, গোলাপ, গন্ধরাজ, করবী এবং রজনীগন্ধারই প্রাদুর্ভাব কিছু বেশি। প্রকাণ্ড একটা বকুলগাছের তলা সাদা মার্বল পাথর দিয়া বাঁধানো ছিল। সুস্থ অবস্থায় তিনি নিজে দাঁড়াইয়া দুইবেলা তাহা ধুইয়া সাফ করাইয়া রাখিতেন। গ্রীষ্মকালে কাজের অবকাশে সন্ধ্যার সময় সেই তাঁহার বসিবার স্থান ছিল। সেখান হইতে গঙ্গা দেখা যাইত কিন্তু গঙ্গা হইতে কুবির পানসির বাবুরা তাঁহাকে দেখিতে পাইত না।’
সেই বাগান আজও আছে। মনে হয় সেই বাগানই। তবে জরাজীর্ণ। সমঝদার মানুষেরা সব চলে গেছেন। এসেছেন ব্যবসাদারেরা। একাল সেকালকে ভাঙতে চায়। তবু আছে। হাতবদল হয়েছে। বিশাল গেট ঠেলে অনুমতি নিয়ে ঢোকা যায়। মোরাম বিছানো পথ। সেই বকুল। বাঁধানো বেদি। তাকিয়ে থাকি। রবীন্দ্রনাথের গল্প থেকে উঠে আসেন দক্ষিণাচরণবাবুর রুগ্ন স্ত্রী।
হঠাৎ চেতনা আসে। দক্ষিণাচরণবাবুর মতো আমিও হ্যালুসিনেশনে আক্রান্ত। হয়তো কেউ শুয়ে আছে। শুয়ে আছে, অসুস্থ বর্তমান। গ্রীষ্মের বাতাস পলিউশনে ভারী। ‘ঘনসুগন্ধপূর্ণ’ নয়, ডিজেলগন্ধী। নীল আকাশের অসীম ছেয়ে ছড়িয়ে গেছে কলের ধোঁয়া। চাঁদ ওঠে। রুপোলি আলোর বদলে পাই পিত্তবর্ণের আলো। এখন ভয় করে। এখন আর আনন্দে নয়, বলি মহা আক্ষেপে, মরিয়া হয়ে কবি যা বলেছিলেন সাধকোচিত বীরত্বে, ‘নাই রস নাই দারুণ দহনবেলা/ খেলো খেলো তব নীরব ভৈরব খেলা।’
রবীন্দ্রনাথ, গ্রীষ্মের বৈরাগ্য-মুগ্ধ ছিলেন। মৌনী তাপস, স্বয়ং রুদ্র হলেন গ্রীষ্ম। কি তার ব্যাপ্তি। কি তার তেজ! বিশ্বমন্দিরে বাঘছালের আসনে এসে বসেছেন দিব্যকান্তি সাধক। শ্বাস বইছে সুষুম্নায়। মাঝে মাঝে চলে যাচ্ছেন কুম্ভকে। তখন গাছের পাতা নড়ছে না, নৌকোর পাল ঝুলে পড়ছে। এই রুদ্রের কাছেই প্রার্থনা, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে/ এ জীবন পুণ্য করো দহনদানে।’