- জয়ন্ত ঘোষাল
এগজিট পোলকে ভুল প্রমাণ করে ইন্ডিয়া জোট লড়েছে প্রচুর, বিজেপির আসন কমেছে, তারা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। কিন্তু ঘটনা হল, নরেন্দ্র মোদিই নেহরুর মতো হ্যাটট্রিক করলেন। তাঁর পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে তাঁদের জোট।
প্রশ্ন উঠতে পারে, লোকে যেখানে অল্পে সন্তুষ্ট হয় না, সেখানে মোদির সাফল্যের কারণ কী?
২০১৪ সালে যখন মোদি ক্ষমতায় এসেছিলেন, তখন গোটা দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ মনে করেছিল যে ভারতে একজন অরণ্যদেব যেন হাজির হয়েছে। অথবা বলা যেতে পারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যেন জেমস বন্ড এসে গিয়েছেন, এখন আর কোনও সমস্যা থাকবে না। ভারতের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। মনমোহন সিং-এর সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং নীতি পঙ্গুতার যে অভিযোগ উঠেছিল, তারপর মোদিকে নিয়ে স্বপ্ন ছিল।
এবার এগজিট পোলের আগের কথা ভাবা উচিত। সেসময়ে ভারতের বহু রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেছিলেন, এবার হয়তো ২০১৪ আর ২০১৯-এর পুনরাবৃত্তি হবে না। মোদির পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা কঠিন হবে। মোদি যখন লোকসভায় বললেন ‘অব কি বার ৪০০ পার’, তখন সবাই ভেবেছিলেন যে এটা মানসিক যুদ্ধের জন্য উনি বলেছেন। ৪০০ অতিক্রম করা তো কম কথা নয়। বহু রাজ্যে বিজেপি প্রায় সব আসন নিয়ে বসে রয়েছে। হিন্দি বলয়, উত্তরাখণ্ড, রাজস্থান, হিমাচলপ্রদেশ, দিল্লি, মহারাষ্ট্র। এত আসন পাওয়ার পর সেটাকে ধরে রাখা একইভাবে জেতা সহজ কাজ না। মোদি সেটা পারেনওনি। কিন্তু যেটা পারলেন, সেটা তৃতীয়বারেও ক্ষমতা ধরে রাখা। সেটা কম বড় কথা নয়।
কেন এতদিন ধরে তারা ক্ষমতায় থাকল?
এবারের লোকসভা নির্বাচনের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য খুব স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে। ১) নির্বাচনের প্রধান চরিত্র হলেন মোদি। বিজেপির শুধু নয়, কার্যত গোটা দেশে মোদির ব্র্যান্ড-ইকুইটি ছিল সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর। মোদির যোগ্য স্ট্র্যাটেজিস্ট এবং দুই নম্বর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শা’র মাইক্রো-ম্যানেজমেন্টের ভূমিকাও ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। মোদি ও শা’র বিজেপির নেতৃত্বের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, তাঁরা ভোটের ব্যাপারে অন্য সব দলের চেয়ে বেশি সক্রিয়।
বিজেপি শুধু ভারতের নয়, গোটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দল। আর্থিক ক্ষমতাও সবচেয়ে বেশি। মোদি-শা রাজনীতি করেন সিরিয়াসলি, তাঁরা দু’দিন রাজনীতি করে সাতদিনের জন্য ছুটি কাটাতে বিদেশ চলে যান না। আর সবচেয়ে বড় কথা, ভোটের অন্তত এক বছর আগে থাকতে বিজেপির রণকৌশল রাজ্যওয়াড়ি ঠিক হয়ে যায় বিভিন্ন পেশাদারি গোষ্ঠীকে দিয়ে দল সমীক্ষা শুরু করে। আর তাই উত্তরপ্রদেশে ভোটের আগে অজিত সিংয়ের পুত্র জয়ন্ত সিং-কে এনডিএ-তে শরিক করে নেওয়া হয়। চরণ সিংকে ভারতরত্ন দেওয়া হয়। যাতে জাঠ ভোট উত্তরপ্রদেশে পাওয়া যায়। উত্তরপ্রদেশের ছোট ছোট দল আছে যে দলগুলি জাতপাতভিত্তিক দল। যারা নানা ক্ষোভে এনডিএ ছেড়ে চলে গিয়েছিল, তাদেরকে আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে। যেমন অনুপ্রিয়া প্যাটেলের দল। প্রত্যেকের সঙ্গে আসন নিয়ে দরকষাকষি সেরে ফেলা হয়। সিবিআই এবং এনফোর্সমেন্টের তদন্তের জন্য মায়াবতী নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। মায়াবতীর দলিত ভোট অনেকটাই অখিলেশের দিকে এবার চলে এসেছে।
কৌশলগতভাবে কংগ্রেস এবং গান্ধি পরিবারকে প্রধান টার্গেট করে মোদি-শা’র লাগাতার প্রচার চলেছে। এটা শুধু ভোটের সময় নয়। গত কয়েক বছর ধরে বিজেপি এই কাজটা করেছে। মোদি গোটা দেশের মানুষের কাছে সারাক্ষণ সোশ্যাল মিডিয়া, সর্বভারতীয় মিডিয়ার মাধ্যমে দৃশ্যমান হয়েছেন। পৃথিবীর কাছে তুলে ধরেছেন বিশ্বগুরু হিসেবে। এই ভাবমূর্তি তিনি লাভ করেছেন। এই বয়সে এক একটা রাজ্যে এতগুলি জনসভা করেছেন যা অভাবনীয়। ফলে আর্থিক সংকট, কর্মহীনতার মতো সমস্যা থাকলেও তার বিরুদ্ধে একটা বিকল্প প্রতিপক্ষ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। মোদিরা হিন্দুত্বে জোর দিয়ে দেশের সংখ্যাগুরু অংশের একটা বিশাল অংশের ভোট নিশ্চিত করতে পেরেছেন। সেটা তাঁদের বাঁচিয়ে দিয়েছে বলা যেতে পারে।
হারতে হারতে মোদির ম্যাচ জিতে যাওয়ার আর কী কারণ?
প্রধান কারণ, মোদির বিরুদ্ধে ইন্ডিয়া জোটের কোনও একজন বিকল্প মুখ দেখা যায়নি। সুতরাং একটা জোড়াতালি দিয়ে কোয়ালিশন সরকারকে ভারতবাসীরা এখন ভয় পায়। কেননা ভারত ১৯৭৭ সালে মোরারজি দেশাইয়ের সরকার দেখেছে, ১৯৮৯ সালে বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহের সরকার দেখেছে, তারপর দেখেছে চন্দ্রশেখরের সরকার। কেউ টিকতে পারেনি। নড়বড়ে ঠেকেছে। ইন্ডিয়া জোট কিন্তু ভোটের আগে কোনও প্রধানমন্ত্রী মুখ তুলে ধরতে পারেনি। তাই উত্তরপ্রদেশের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বিশাল ধাক্কা দিয়েও লাভ হল না।
(লেখক সাংবাদিক)