- পঙ্কজ কুমার চট্টোপাধ্যায়
বিভূতিভূষণের ‘ফকির’ গল্পে ইছু মণ্ডল ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে নিয়মমতো নমাজ পড়ে জনে খাটতে যাওয়ার আগে বৌ নিমিকে বললে- খিদে পেয়েছে। কী আছে রে?
—কিছু নেই।
—দেখ না হাঁড়িটা- বড্ড খিদে পেয়েছিল।
—দুটো-ক’টা পানি দেওয়া ভাত পড়ে আছে, আর কিছু নেই।
—তাই দে। বেনবেলা না- খেয়ে গেলি দুপুরবেলা এমন খিদে পায়, দা ধরতি হাত কাঁপে। কাজ করতি পারিনে।
ইছু মণ্ডলের গ্রামে ডিজিটাল বিভাজন ভেঙে এখন ঢুকে পড়েছে স্মার্টফোন। উজ্জ্বলা প্রকল্পের মাধ্যমে পাওয়া গ্যাস সিলিন্ডার। এক কিলো মোটা চালের দাম ৩৫-৪০ টাকা। সবজির কিলো প্রতি গড় দাম কমপক্ষে ৪০- ৫০ টাকা। এই অবস্থায় গ্রামের মানুষ দৈনিক মাথাপিছু ৩২ টাকা খরচ করলে আর দরিদ্র থাকবে না।
নিয়মমতো দারিদ্র্যসীমার গণসমীক্ষা ২০১৭-’১৮ সালে সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু সেই সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি। কারণ রিপোর্ট নাকি অসংগতিতে পূর্ণ। অর্থাৎ রিপোর্ট মনমতো হয়নি। মিথ্যা বলেনি। আমরা যে মিথ্যার বেসাতি করা স্বাধীনতার পর থেকেই শিখে এসেছি।
হিটলার নিজে তাঁর আত্মজীবনীমূলক রচনা ‘মেইন কেমফ’-এ বলেছেন, ‘বেশিরভাগ মানুষের মনের আদিম সরলতার কারণে, জাতির সাধারণ মানুষ অধিক দ্রুততায় ক্ষুদ্র মিথ্যার থেকে বৃহৎ মিথ্যার শিকার হয়, কারণ তারা নিজেরা প্রায়শই ক্ষুদ্র বিষয়ে ক্ষুদ্র মিথ্যা বলে কিন্তু বৃহদাকারে মিথ্যাচারে তারা লজ্জা পাবে। তাদের মগজে কখনোই বৃহদাকার অসত্য নির্মাণে প্রবৃত্ত হওয়ার চিন্তা আসবে না এবং তারা বিশ্বাস করবে যে, অপর ব্যক্তিরাও সত্যকে জঘন্য রূপে বিকৃত করতে পারে না।’ আর তাই, মিথ্যা যত নির্লজ্জ হবে, ততই বিশ্বস্ততা মনে হবে। উল্লেখযোগ্য, ইতিহাসে ধিক্কৃত হিটলার নির্বাচনে জিতে জার্মানিতে ক্ষমতায় এসেছিলেন।
তাই মিথ্যার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সবুরে মেওয়া ফলেছে। নীতি আয়োগের সিইও বলেছেন, সদ্য প্রকাশিত দারিদ্র্যসীমার গণসমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতে বর্তমানে মাত্র ৫% মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে আছেন। এই তথ্য সত্য হলে তা ভারতের জিডিপি ৩ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছোনোর লক্ষ্য থেকেও চমকপ্রদ। এমনকি চন্দ্রাভিযান এবং সৌরাভিযানের থেকেও মূল্যবান। দারিদ্র্যসীমার নীচে মানুষের সংখ্যা ২০১১-’১২ সালে ২২% থেকে দশ বছরে ৫% নেমে আসতে পারলে, ০% কেন হল না। চক্ষুলজ্জা বলে কিছু আছে তো! আরে আমেরিকার মতো দেশে দারিদ্র্য-হার ২০২১-এর ৭.৪% থেকে ২০২২ সালে ১২.৪% হয়েছে। আমেরিকাতে জলের থেকে হয়তো মদ অধিকলভ্য, তাই জল মেশানো যায়নি।
আমাকে নিন্দুক বলে ঠাওরাবেন না। একটু ধৈর্য ধরুন। ২০১৪ সালে প্রাক্তন রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর সি রঙ্গরাজনের নেতৃত্বে এক প্যানেল দারিদ্র্যসীমা নির্ণয় করতে গ্রামাঞ্চলে মানুষের মাথাপিছু মাসিক খরচ স্থির করেছিলেন ৯৭২ টাকা আর শহরাঞ্চলে ১,৪০৭ টাকা। অর্থাৎ গ্রামাঞ্চলে মাথাপিছু দৈনিক খরচ ন্যূনতম ৩২ টাকা হলেই সে দরিদ্র থাকবে না।
ইছু মণ্ডলের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। নতুন রিপোর্ট অনুযায়ী দেশে, ইছুদের গ্রামাঞ্চলে মাথাপিছু মাসিক খরচের পরিমাণ হয়েছে ২০২২-’২৩ সালে ৩৭৭৩ টাকা। তাহলে তো দারিদ্র্যসীমার নীচে কোনও মানুষ থাকার কথা নয়! বাকিটা বুঝে নিন।
(লেখক প্রাবন্ধিক। আলিপুরদুয়ারের ভূমিপুত্র, এখন থাকেন খড়দহে।)