তমালিকা দে, শিলিগুড়ি: এখনও অশান্ত মণিপুর। বাতাসে ভাসছে গোলা-বারুদের গন্ধ। দিন-রাত শোনা যাচ্ছে সেনা জওয়ানদের ভারী বুটের আওয়াজ। বাড়ি থেকে প্রায়ই ফোনে মিলছে গোলাগুলি আর মৃত্যুর খবর। বুকে বাসা বাঁধছে একরাশ ভয়। মাঝেমধ্যেই দুরুদুরু বুকে ফোন ধরতে হয়। না জানি কখন শুনবেন পরিবারের লোকজনকে হারানোর খবর। এমনই ভয় বুকে নিয়ে রোজ দর্শকদের আনন্দ দিতে সার্কাসের এরিনায় হাজির হন মণিপুরের ১৩ শিল্পী। লাইমলাইটের জোরালো আলোয় তিন ঘণ্টার শোয়ে তাঁদের উচ্ছ্বসিত হাসিমুখের নীচে চাপা পড়ে যায় বুকভরা আতঙ্ক। কিন্তু সত্যিই কি চাপা পড়ে? দর্শক আসন থেকে যদিও তা বোঝার উপায় নেই। কিন্তু তাঁদের অন্দরমহলে পা দিতেই এই আতঙ্কের আঁচ মেলে।
অসচ্ছল পরিবার। টাকা আয়ের জন্য ছেলেবেলায় শেখা জিমনাস্টিকের কলাকৌশলই এখন পেট চালানোর হাতিয়ার। দলে ঢুকে সেই কৌশল আরও ত্রুটিহীন করতে দৈনিক সকালে অনুশীলন ‘মাস্ট’। সেখানেও সবকিছু ভুলে চালাতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনুশীলন। তারপর দৈনিক একটা, চারটে ও সন্ধ্যা সাতটায় শোয় তার প্রদর্শন। তাঁদের এই কলাকৌশল প্রদর্শন দর্শকদের আনন্দ দেয়। কানে আসে হাততালির শব্দ। কিন্তু বুকে চেপে থাকে যে কোনও সময় কাছের মানুষদের হারানোর আতঙ্ক। শিলিগুড়ির জলপাই মোড়ে প্রায় একমাস ধরে চলছে রোলেক্স সার্কাস। সেখানে মূল আকর্ষণ মণিপুরের সাত মহিলা ও ছয় পুরুষ শিল্পী।
মণিপুরের থৌবাল জেলার বাসিন্দা রবিন সিং এই সার্কাসের নিয়মিত শিল্পী। তিনি বলেন, ‘বাড়ি থেকে প্রায় রোজই বাবা ফোনে জানান আমাদের মহল্লার অবস্থা খুব একটা ভালো না। মাঝে মাঝেই শোনা যায় গুলি-বারুদের শব্দ। ভয়ে বাবা-মা ঘরে তালা দিয়ে থাকেন। আমিও সবসময় ফোনে যোগাযোগ রাখছি। কবে যে মণিপুর শান্ত হবে ভগবানই জানেন।’ গত বছরের ৩ মে থেকে মণিপুরে শুরু হয়েছিল কুকি ও মেইতেইদের সংঘর্ষ। তা এখনও অব্যাহত। আপাতত কুকি ও মেইতেই প্রধান এলাকাগুলি ভাগাভাগি করে মাঝে থাকছে সেনাবাহিনী। দিনরাত টহল দিচ্ছে পুলিশ। জীবনযাত্রা অনেকটাই অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছে। ‘পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বাড়িতে বাবা-মাকে টাকা পাঠাতে হবে। কারণ, এখন বাবার কাজ নেই। মণিপুরে অবস্থা এতটা খারাপ হয়েছে যে, কখন বাবা-মাকে হারাতে হয় কে জানে? খুব ভয় লাগে।’ এমনটাই বললেন শিল্পী মুক্তা মেইতেই ও তোমাস মেইতেই।
ওই সাকার্সের ম্যানেজার মোল্লা সাদেক রহমান বলেন, ‘মণিপুরের উত্তপ্ত পরিস্থিতির জন্য শিল্পীরা আতঙ্কিত। কিন্তু দৈনিক তিনটে শো-তে খেলা দেখানোর সময় তাঁদের দেখে তা বোঝা যায় না।’ স্কুল পড়ুয়াদের জন্য টিকিটে বিশেষ ছাড় রয়েছে বলে সাদেক জানান।