উত্তরবঙ্গ ব্যুরো : এই তো গত সোমবারের কথা। পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রচারে কোচবিহারে এসে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য ছিল ‘মহাঘোঁট ভেঙে দেব’। মমতার অভিযোগ ছিল পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় বামফ্রন্ট, কংগ্রেস ও বিজেপি মিলিতভাবে প্রার্থী দিচ্ছে। তৃণমূলের পক্ষে সেই ‘মহাঘোঁট’ ভাঙা সম্ভব হবে কি না, তা সময়ই বলবে, তবে আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়ি জেলার একাধিক গ্রাম পঞ্চায়েতে এই তৃণমূল বিরোধী জোট দেখা যাচ্ছে। কোথাও নির্দল প্রার্থীর হয়ে প্রচার করছে বাম ও বিজেপি। আবার কোথাও কংগ্রেস প্রার্থীকে সমর্থন করে প্রচার করছে রাম ও বামেরা।
আলিপুরদুয়ার-১ ব্লকে গ্রাম পঞ্চায়েতের কিছু আসনে তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিরোধীদের সংঘবদ্ধভাবে লড়াই করতে দেখা যাচ্ছে। যেমন ধরা যাক পররপার গ্রাম পঞ্চায়েতের ১০৫ নম্বর বুথের আসনটি। বীরপাড়া এলাকার ওই আসনে লড়াইটা তৃণমূলের সুশীলা রায় বনাম নির্দল প্রার্থী চন্দন মণ্ডলের। অন্য কোনও দল এই আসনে প্রার্থীই দেয়নি। ওই নির্দল প্রার্থীকেই বামফ্রন্ট, বিজেপি, কংগ্রেস সমর্থন জানিয়েছে। তৃণমূল বিরোধী ভোট এক জায়গায় রাখতেই এই পরিকল্পনা বলে জানা গিয়েছে।
চন্দন এই রামধনু সমর্থন নিয়ে মুখে কিছু বলছেন না। তাঁর অল্প কথায় বক্তব্য, ‘মানুষ সবকিছু দেখে ভোট দেবে।’ কিন্তু প্রার্থী নিজে না বললে কী হবে, এলাকায় সিপিএমের একটা অংশ ওই যুবকের হয়ে ভোট প্রচার করছেন। বাম ও বিজেপি নেতারা যখন পঞ্চায়েত সমিতি বা জেলা পরিষদের প্রার্থীর হয়ে ওই এলাকায় প্রচারে যাচ্ছেন, তখন গ্রাম পঞ্চায়েতের ভোট নির্দল প্রার্থীকে দিতে বলছে। একই কায়দায় নির্দল প্রার্থীর প্রচার করছে গেরুয়া শিবিরও। কংগ্রেস যে রাস্তায় নেমে নির্দল প্রার্থীর জন্য খুব প্রচার করছে, তা নয়। কারণ কং নেতাদের বক্তব্য, ওই এলাকায় সেভাবে প্রচার চালাবার মতো তাদের সাংগাঠনিক শক্তি নেই।
বিজেপির ৩ নম্বর মণ্ডল সভাপতি জয়দেব রায়ের কথায়, ‘নির্দল হয়ে জিতলে ওই প্রার্থী বোর্ড গঠনে আমাদের সঙ্গে থাকবেন বলেছেন।’ অন্যদিকে সিপিএমের আলিপুরদুয়ার পশ্চিম এরিয়া-২ কমিটির সম্পাদক জীবন দাস জানালেন, ‘নির্দল প্রার্থীর প্রতীকে শাসকদলের বিরোধী ভোট একজায়গায় দিতে কোনও সমস্যা হবে না। তাই এই কৌশল।’
এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, অনেক জায়গাতেই নির্দল, বাম, বিজেপির পতাকা পাশাপাশি। নির্দল প্রার্থীকে অন্য দলের সমর্থনের বিষয়টি নিয়ে এলাকায় বেশ চর্চা চলছে। স্থানীয়দের অনুমান, এর ফলে বাম ও বিজেপির ভোট ওই নির্দল প্রার্থী পাবেন। অন্যদিকে, কংগ্রেসের ওই এলাকায় তেমন শক্তি না থাকলেও যেক’টি ভোট রয়েছে সেটা পাবেন ওই নির্দল প্রার্থীই।
যতই বিরোধীরা নির্দল প্রার্থীকে সমর্থন করুক না কেন, ওই আসনের তৃণমূল প্রার্থী সুশীলা জয়ের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী। তাঁর কথায়, ‘আমি আগেও এলাকায় জনপ্রতিনিধি ছিলাম। মাঝে কয়েক বছর ভোটে দাঁড়াইনি। মানুষের কাজ করেছি। মানুষের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রয়েছে। জয়ী হবই।’
পররপারের ওই ছবি কিছুটা মিল পাওয়া যাচ্ছে আলিপুরদুয়ার-১ ব্লকেরই পাতলাখাওয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের। ওই অঞ্চলের ১৩টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসনের মধ্যে তিনটি আসনে প্রার্থী দেয়নি বিজেপি। তার মধ্যে দু’জায়গায় বাম এবং এক জায়গায় কংগ্রেসকে তলে তলে সমর্থন জানাচ্ছে তারা।
এত গেল আলিপুরদুয়ারের কথা। এদিকে, পাশের জেলা জলপাইগুড়ির বারোঘরিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের পাটকিদহ গ্রামে ঢুকেই দেখা গেল কংগ্রেস প্রার্থী নিরবালা রায়ের নির্বাচনি শিবির। সেখানে একসঙ্গে সিপিএম, কংগ্রেস ও বিজেপির পতাকা উড়ছে। তিন দলের নেতৃত্বই প্রকাশ্যে তাদের রামধনু জোট গঠনের কথা অকপটেই স্বীকার করে নিয়েছেন।
বারোঘরিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৫/১৬৫ নম্বর অংশে কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন নিরবালা। সিপিএম নেতৃত্বের দাবি, গ্রাম পঞ্চায়েতের একেবারে নীচু স্তরে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই কংগ্রেস প্রার্থীকে সমর্থন করে প্রচারে নামা হয়েছে। একইরকম যুক্তি বিজেপি নেতৃত্বের কথাতেও। বিজেপির পূর্ব মণ্ডল কমিটির সদস্য তথা পাটকিদহ গ্রামের বাসিন্দা সুরেন রায় জানালেন, পাটকিদহ গ্রামে কংগ্রেসের ঘাঁটি শক্ত। তাই তৃণমূল প্রার্থীকে হারাতে আলাদা প্রার্থী না দিয়ে সরাসরি কংগ্রেস প্রার্থীকেই সমর্থন করা হয়েছে।
মনোনয়নপত্র পেশ করার সময় থেকেই এই বিরোধী জোটের বিষয়টি সামনে এসেছে। প্রচারের ক্ষেত্রেও সহাবস্থান বজায় রয়েছে। এদিকে, নিরবালা কখনও নিজ দলীয় কর্মীদের নিয়ে প্রচারে বের হচ্ছেন। আবার কখনও জোট সঙ্গীদের নিয়েও গ্রামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার সারছেন।
পাটকিদহ গ্রামের ওই অংশে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন লিপিয়ারা বেগম। লিপিয়ারা অবশ্য এসব জোটকে পাত্তা দিতে নারাজ। দলের স্থানীয় নেতা দীপু রায় বলেন, ‘গ্রামে অশুভ জোট হয়েছে। ওখানে বরাবর তৃনমুল কংগ্রেস জয়ী হয়ে আসছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না।’
জলপাইগুড়ি জেলায় তো খোদ প্রদেশ কংগ্রেসের সহ সভাপতি ও দলের বর্ষীয়ান নেতা নির্মল ঘোষদস্তিদার তো বুধবার নাগরাকাটায় দলীয় সভায় বলেই দিয়েছেন, তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপিকে আটকাতে অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক প্রার্থীদের মধ্যে যাঁর জয়ের সম্ভাবনা বেশি, তাঁকেই সমর্থন করতে হবে। এদিকে, বারোঘরিয়ায় তো কংগ্রেস, বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েই বসে রয়েছে।