দীপ্তিমান মুখোপাধ্যায়, কলকাতা : জমি কেলেঙ্কারিতে সবচেয়ে বেশি নজর কোচবিহার, জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার জেলায়। রাজ্যের অ্যান্টি করাপশন সেলের প্রাথমিক তদন্তে ধরা পড়েছে, এই তিন জেলায় বড় চক্র সক্রিয়। কোচবিহার জেলায় প্রায় ৮ হাজার একর এবং আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়ি জেলা (অবিভক্ত জলপাইগুড়ি জেলা) মিলিয়ে সাড়ে ১২ হাজার একর জমির চরিত্র বদল করে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে বলে হদিস মিলেছে। এছাড়া মালদা জেলায় ৩ হাজার একর জমির চরিত্র বদল করা হয়েছে। সব মিলিয়ে উত্তরবঙ্গে প্রায় ৩৫ হাজার একর জমি লোপাট হয়ে গিয়েছে বলে আশঙ্কা নবান্নের।
ওই জমির চরিত্র বদল সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়েছে। গত কয়েক বছরে কোন মৌজায় কত জমির চরিত্র বদল হয়েছে, তার পুরো পরিসংখ্যান আগামী সপ্তাহের মধ্যে নবান্নে পাঠাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে যে তদন্ত চলছে, তার বিস্তারিত রিপোর্ট ১৫ দিনের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পেশ করবেন রাজ্যের ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তরের প্রধান সচিব।
ইতিমধ্যে উত্তরবঙ্গে ৮ জেলার যে ৩৫ জন আধিকারিকের কাজকর্ম তদন্তের আওতায় রয়েছে, তাঁদের সিংহভাগ এই তিন জেলার। তাঁদের কেউ কেউ অন্য দপ্তরে বদলি হয়ে গিয়েছেন। যাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে, তাঁদের ১২ জনই কোচবিহার জেলায় কোনও না কোনও সময় কর্মরত ছিলেন। জলপাইগুড়ি জেলায় ওই সংখ্যা ১০ জন। এছাড়া আলিপুরদুয়ারের ৭ ও মালদা জেলার ৬ জন আছেন। এঁরা সবাই অনৈতিকভাবে জমির চরিত্র বদলে অভিযুক্ত।
তদন্ত শুরু হলেও প্রশাসনের নাকের ডগায় এত বড় জমি কেলেঙ্কারি ঘটায় একাধিক প্রশ্ন উঠছে। এই ঘটনায় তৃণমূলের কয়েকজন মাঝারি স্তরের নেতার প্রত্যক্ষ যোগাযোগের প্রমাণ পেয়েছে প্রশাসন। ওই নেতাদের আড়াল না করার জন্য সংশ্লিষ্ট জেলাগুলির প্রশাসনের কাছে মুখ্যমন্ত্রীর বার্তা পৌঁছে গিয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, রাজনৈতিক প্রভাব না থাকলে শুধু সরকারি অফিসাররা নিজের দায়িত্বে এভাবে ঢালাও জমির চরিত্র বদল করার সাহস পেতেন না।
অথচ প্রাথমিকভাবে শুধু সরকারি অফিসারদের বলির পাঁঠা করা হচ্ছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ। তাদের বক্তব্য, পিছনের মাথাদের ধরার কোনও লক্ষণ এখনও নেই। প্রবীণ সিপিএম নেতা তথা বাম আমলের মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘শিলিগুড়ির কাছে ডাবগ্রাম, পাথরঘাটা, চম্পাসারি, ১৮ মাইল, মাটিগাড়া-১ এলাকায় বিপুল পরিমাণে জমির চরিত্র বদল করা হয়েছে।’ তাঁর কথায়, ‘এলাকার এক দাপুটে তৃণমূল নেতা এ কাজে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। প্রশাসন সব জানে। কিন্তু এতদিন কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি।’
অশোকের বক্তব্য, ‘ওই নেতার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হবে বলে মনে হচ্ছে না। এই তদন্ত শুধু লোকদেখানো। আদৌ আসল অপরাধীরা ধরা পড়বে বলে মনে হয় না।’ শিলিগুড়ির বিজেপি বিধায়ক শংকর ঘোষের ভাষায়, ‘দিনের পর দিন উত্তরবঙ্গজুড়ে তৃণমূল নেতারা জমির অনৈতিক কারবার করছেন। প্রশাসন কি জানে না? এখন তদন্তের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু শুধু কয়েকজন অফিসারকে ধরে লাভ নেই। বড় মাথাকে ধরতে হবে।’
উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী উদয়ন গুহের পালটা বক্তব্য, ‘বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি কথা নিয়ে মন্তব্য করব না। সিপিএম আমলে কী হয়েছে, তা সকলেই জানে। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই এই ঘটনার তদন্ত করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তদন্তের তদারকিও তিনি করছেন।’ গত কয়েক বছর ধরে এই জমি কেলেঙ্কারি চরমে উঠলেও এর সূত্রপাত তৃণমূল জমানা শুরু হওয়ার আগে বলে তদন্তে উঠে আসছে।
অ্যান্টি করাপশন সেল গোটা ঘটনার গভীরে যেতে চাইছে বলে নবান্ন সূত্রে খবর। বাম আমলে এই দুর্নীতিতে কাদের মদত ছিল, তাও খতিয়ে দেখতে শুরু করেছেন অ্যান্টি করাপশন সেলের অফিসাররা। শিলিগুড়ি ও সংলগ্ন এলাকায় বেশ কিছু জলাভূমি ভরাট করে আবাসন তৈরির সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারদের বয়ানও রেকর্ড করতে পারেন তদন্তকারীরা। যদিও তাঁদের অনেকে এখন অবসরপ্রাপ্ত। তবু তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে।