Saturday, September 23, 2023
HomeTop Newsকার্বন ডাইঅক্সাইড শুষে নেবে কংক্রিট, আবিষ্কার তুফানগঞ্জের মানসের

কার্বন ডাইঅক্সাইড শুষে নেবে কংক্রিট, আবিষ্কার তুফানগঞ্জের মানসের

শুভজিৎ অধিকারী, শিলিগুড়ি : ধরুন এমন একটা বাড়ি বানালেন, যে বাড়ির কংক্রিট বায়ুর কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে নেবে? শুনতে কি একটু অদ্ভুত লাগছে? মনে হচ্ছে এমন তো কল্পবিজ্ঞানে হয়? কিন্তু এমন ‘কল্পনা’-কেই বাস্তবে রূপ দিয়েছেন তুফানগঞ্জের বাসিন্দা গবেষক ডঃ মানস সরকার। বর্তমানে মানস লস অ্যাঞ্জেলেসের ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ায় সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গবেষণা করছেন। তিনি এমন এক সিমেন্ট দিয়ে তৈরি কংক্রিট তৈরি করেছেন, যা পরিবেশ থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড শুষে নিতে সক্ষম। বর্তমানে বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে আমরা সকলে চিন্তিত। প্রতিদিনই উষ্ণায়নের বিভিন্ন ক্ষতিকর দিকের কথা নতুন নতুন গবেষণায় উঠে আসছে। মানসের মতে, তাঁর এই আবিষ্কার উষ্ণায়ন মোকাবিলায় বড় ভূমিকা পালন করতে চলেছে। এখনও বাণিজ্যিকভাবে ওই সিমেন্টের ফর্মুলা ব্যবহার শুরু না হলেও অদূর ভবিষ্যতে তা শুরু হয়ে যাবে বলে আশাবাদী তিনি।

তুফানগঞ্জ শহরের ১০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মানস। সাধারণ পরিবার থেকেই উঠে আসা। তাঁর বাবা ছিলেন বায়োলজির শিক্ষক। বাবার অনুপ্রেরণাতেই পথচলা শুরু তাঁর। তুফানগঞ্জ এনএনএম হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর পদার্থবিদ্যা নিয়ে স্নাতক স্তরে ভর্তি হন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্নাতকোত্তরে বিশেষ বিষয় ছিল বায়োফিজিক্স। জীববিদ্যার সঙ্গে পদার্থবিদ্যার মেলবন্ধন ঘটে সেখানে। যাদবপুরেই পিএইচডি করেন মানস। তখন থেকেই কংক্রিট নিয়ে গবেষণা শুরু তাঁর। মানসের গবেষণার বিষয় ছিল ব্যাকটিরিয়ার সাহায্যে কংক্রিটের ফাটল কীভাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সারিয়ে ফেলা যায়। তাঁর এই গবেষণা বিভিন্ন জায়গায় সাড়া ফেলে। এই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত সরকারি কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে ডাক এলেও মানস চিনের ঝেজিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করতে চলে যান। সেখানে তাঁর বিষয় ছিল ন্যানো মেটিরিয়াল ব্যবহার করে কীভাবে সিমেন্ট কংক্রিটের স্থায়িত্ব বাড়ানো যায়।

তাঁর এই গবেষণাপত্র বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হওয়ার পর সুইডেনের একটি বিজ্ঞান সংস্থার তরফে ডাক পান মানস। এরপর ডেনমার্কের আরহাস বিশ্ববিদ্যালয়ে। আড়াই বছর ধরে সেখানেও সিমেন্ট রসায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করেন। তবে শুধু বিদেশেই নয়, ভারতেও বিভিন্ন গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মানস। তাঁর মধ্যে অন্যতম কম কার্বনযুক্ত সিমেন্ট তৈরি এবং আইআইটি মাদ্রাজে হাইস্পিড রেল নিয়ে গবেষণা। এরপরে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন তিনি।

ক্যালিফোর্নিয়া থেকে মানস বলেন, সিমেন্ট উত্পাদনের সময় এমনিতেই কার্বন ডাইঅক্সাইড উত্পন্ন হয়। প্রত্যেক এক টন সিমেন্টের জন্য প্রায় ০.৯ টন  কার্বন ডাইঅক্সাইড বাতাসে মেশে, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক। কিন্তু তার নতুন খোঁজ এতদিন ধরে চলে আসা এই প্রক্রিয়াকেই বদলে দিতে সক্ষম। মানসের দাবি, তাঁর এই নতুন কংক্রিট পাঁচ থেকে আট শতাংশ কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করতে পারে। ফলে দু’দিক থেকেই লাভবান হবে মানব সভ্যতা। তাঁর নতুন ধরনের সিমেন্ট তৈরির জন্য মানস বেছে নিয়েছেন দুটি খুবই সাধারণ সামগ্রীকে। তার মধ্যে একটি হল ফ্লাই অ্যাশ, কলকারখানার বর্জ্য হিসেবে যা পরিবেশ দূষণ ঘটায়। ফ্লাই অ্যাশকে কীভাবে পুনর্ব্যবহার করা যায়- তাঁরও পথ দেখিয়েছেন মানস। আর একটি সামগ্রী হল ক্যালসিয়াম হাইড্রক্সাইড বা সহজ বাংলায় কলিচুন। এই দুই সামগ্রীকে বিশেষভাবে সঠিক মাত্রায় মেশানো হয়। তাঁর সঙ্গে যোগ করা হয় বেশ কিছু রাসায়নিক। এভাবেই তৈরি হয় নতুন ধরনের কংক্রিট। কিন্তু কীভাবে এই সিমেন্টের কংক্রিট কার্বন ডাইঅক্সাইডকে আটকে রাখছে? মানস জানান, এই সিমেন্ট দিয়ে তৈরি কংক্রিটে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র ও ফাঁকা জায়গা থাকছে সেই ছিদ্রগুলিকে এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যা কার্বন ডাইঅক্সাইডকে শোষণ করে কলিচুন চুনাপাথরে পরিবর্তিত হয়ে তার মধ্যেই আটকে রাখছে। ঠিক যেভাবে গাছ সালোকসংশ্লেষের জন্য কার্বন ডাইঅক্সাইড শুষে নেয়, সেভাবেই। একই সঙ্গে ক্যালসিয়াম হাইড্রক্সাইডের সঙ্গে কার্বন ডাইঅক্সাইড মিশে তৈরি হচ্ছে ক্যালসিয়াম কার্বনেট যা কংক্রিটের স্থায়িত্ব আরও বাড়িয়ে দেয় এবং মজবুত করে তোলে। মানস আরও জানান, শুধু নতুন কংক্রিট নয়, পুরোনো কংক্রিটের ওপরেও তাঁর এই ফর্মুলা কার‌্যকরী। ফলে পুরোনো বাড়ি ও স্থাপত্য নিজে থেকেই কার্বন ডাইঅক্সাইড শুষে নিতে সক্ষম হবে।

বিশ্বজুড়েই বিজ্ঞানীরা কার্বনের ব্যবহার কমানো নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন। কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমাতে পরিবেশবান্ধব যন্ত্র তৈরিও হয়ে চলেছে। বিশ্বজোড়া সেই উদ্যোগে এবার জুড়ে যাচ্ছে উত্তরবঙ্গের নামও। সৌজন্যে মানসের এই নবতম আবিষ্কার।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments