শিবশংকর সূত্রধর, কোচবিহার: কয়েকদিন আগেকার কথা বলতে গিয়ে সোমবারও গলা কাঁপছিল অঞ্জলি-বিষ্ণুপ্রসাদের। অবসরপ্রাপ্ত ওই অধ্যাপক দম্পতি একাই বাড়িতে থাকেন। দুজনেরই বয়স সত্তর পেরিয়েছে। একমাত্র ছেলে গবেষণা করছেন জার্মানিতে। কয়েকদিন আগেই রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন অঞ্জলি মুখোপাধ্যায়। সেই সময় বাড়িতে বৃদ্ধ বিষ্ণুপ্রসাদ ছাড়া আর কেউই নেই। এই অবস্থায় কী করবেন? বুঝে উঠতে না পেরে ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। পরদিন একটি নার্সিংহোমে গিয়ে চিকিৎসা করান অঞ্জলি। টাকাপয়সা বা কোনও কিছুরই তো অভাব নেই। কেবল লোকবলের অভাবটা ইদানীং বড্ড বেশি বুঝতে পারছেন তাঁরা। বিষ্ণু বলছিলেন, ‘সেদিন বাড়িতে কেউ থাকলে হয়তো রাত থেকেই চিকিৎসা করা সম্ভব হত।’
কলকাতা, মুম্বইয়ের মতো বড় শহরগুলির বড় বড় বহুতলের ঘরে ঘরে এমন কাহিনী। সেই ‘অভিজাত ট্রেন্ড’-এর ছোঁয়া এখন লেগেছে কোচবিহারের (Cooch Behar) মতো শহরেও। এখানেও এমন একাকিত্বে ভোগা দম্পতির সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে। কাজের তাগিদে বৃদ্ধ বাবা-মাকে বাড়িতে একা রেখেই কর্মস্থলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন সন্তানরা। রবিবার কোচবিহারে অভিজাত এলাকায় ফাঁকা ফ্ল্যাট থেকে একা থাকা বৃদ্ধার দেহ উদ্ধারের ঘটনার পর নাড়াচাড়া শুরু হয়েছে সেই একাকিত্ব নিয়েই।
আর সেইসঙ্গে বাড়ছে অবসাদ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে ওই বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা বাড়ির পরিচারিকার উপর নির্ভর করেই থাকেন। বাইরে থাকা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। বড়জোর ন’মাসে-ছ’মাসে তাঁরা বাড়িতে আসেন, দেখা করে যান। নিজেদের যোগ্যতাতেই তাঁরা আজ দেশে-বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং ব্যস্ত। সবসময় সন্তানদের পাশে পাওয়ার সুযোগ নেই। তাই চিকিৎসা দৈনন্দিন নানা কাজ সারতে অসুবিধায় পড়েন একা থাকা বয়স্করা।
অঞ্জলি বললেন, ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদেই খবর দেখে জানতে পেলাম গোলবাগানে একা ফ্ল্যাটে থাকা এক বৃদ্ধা মারা গিয়েছেন। দু’দিন পর তাঁর দেহ পাওয়া গেল। একা থাকার এরকম অনেক অসুবিধা রয়েছে। এখন তো যৌথ পরিবার প্রায় উঠেই গিয়েছে। ছেলেমেয়েরাও কর্মসূত্রে বাইরে থাকলে এরকম অনেক অসুবিধার মুখোমুখি হতে হয়।’
শেষ বয়সে ভরসায় জায়গাটা খুব প্রয়োজন বলেই মনে করেন কোচবিহারের বাসিন্দা অসীম গুহ। তিনি বললেন, ‘ছেলেমেয়েদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য তারা বাইরে গিয়ে কাজ করবে, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। তা বলে আবার বয়স্ক বাবা-মা বাড়িতে একা থেকে সমস্যায় ভুগবেন এটাও মানা যায় না।
রবিবার গোলবাগান এলাকায় যে ফাঁকা ফ্ল্যাট থেকে ৭২ বছরের বৃদ্ধার দেহ উদ্ধার হয়েছে, তিনিও দীর্ঘদিন ধরে সেখানে একাই থাকতেন। তাঁর দেহের পাশে ওষুধের প্যাকেট পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল। এদিনও ওই এলাকা থমথমে দেখা গিয়েছে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একাকিত্ব থাকাটা বয়স্কদের কাছে বড় একটি সমস্যা। এমজেএন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মনোরোগ চিকিৎসক ডাঃ চিরঞ্জীব রায়ের বক্তব্য, ‘ষাটোর্ধ্ব মানুষেরা একা থাকার সময় অজানা ভয়, একাকিত্ব, নিজেকে অসহায় ভাবা সহ নানারকম নেগেটিভ চিন্তাভাবনা করতে থাকেন। তাঁদের মানসিক ও শারীরিক অবস্থার উপর কুপ্রভাব পরে। এই সময় বয়স্কদের বিভিন্ন জিনিস দিয়ে ব্যস্ত রাখা উচিত। তাঁরা যাতে একাকিত্বে না ভোগেন সেদিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন।’
কিন্তু সেই লক্ষ্য রাখবেটা কে?